কুয়েতে নার্স প্রেরণে অসম্মতি: সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন।

health Nurse
OT

চৌধুরী আহসানুল হায়দার
সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় ডেপুটি সেক্রেটারি কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি
বিজ্ঞপ্তিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের নার্সিং সমাজে কিছু মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কুয়েত সরকার আমাদের শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ১০০ চিকিৎসক ৫০০ জন আইসিইউ নার্স নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয সাম্প্রতিককালের করোনা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে ৫০০ জন নার্স প্রেরণে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। কিন্তু একটি চিঠির মাধ্যমে অসম্মতি জ্ঞাপন করার পূর্বে আমরা যে সকল বিষয় বিবেচনা করা দরকার ছিল সে সকল বিষয় কি বিবেচনা করে দেখেছি?

কুয়েত আমাদের অত্যন্ত বন্ধুপ্রতিম একটি দেশ।
১৯৯০ সালে যখন ইরাকের সাম্রাজ্যবাদী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এক অজ্ঞাত কারণে ছোট্ট দেশ কুয়েত দখল করে নেন, তখন আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। কারন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে জোরপূর্বক দখল করে নেয়াটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সাদ্দাম হোসেনের এহেন কর্মকাণ্ড ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সূত্রপাত করে। জাতিসংঘ তখন ইরাকের কবল থেকে কুয়েত মুক্তকরণের অভিযানে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তখন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ওই অভিযানে অংশ নিয়ে কুয়েতকে মুক্ত করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই সাহায্য-সহযোগিতায় পরবর্তীতে কৃতজ্ঞতাবশত কুয়েত সরকার খুশি হয়ে বাংলাদেশকে অনেক সহযোগিতা করে। রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল কুয়েত বাংলাদেশের ভ্রাতৃত্ববোধ এর জ্বলন্ত উদাহারন.

বাংলাদেশি নার্সদের বিদেশে গমন নতুন কিছু নয়।
আশির দশকে এবং নব্বইয়ের দশকে লিয়েনে এমনকি ২০০০ সালের পর থেকেও অনেকে লিবিয়া, কাতার এবং ওমান গিয়েছেন। তারা সেখানে অত্যন্ত সফলতার সাথে চাকরি করেছেন এবং দেশের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে এসেছেন।

এবার একটু অন্য দিকে আলোকপাত করি। আমাদের দেশে সরকারী এবং বেসরকারী হাসপাতাল মিলে অনেকগুলো স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে একজন রেজিস্টার্ড নার্স ডিপ্লোমা বা বিএসসি যেই হোক তার কিন্তু বেতন এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দিনে খুবই অপ্রতুল। মফস্বল এলাকায় অবস্থা আরো শোচনীয়। সেখানে নার্সদের চাকরির নূন্যতম কোন নিশ্চয়তা নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রেজিস্টার্ড নার্স নিয়োগের কথা থাকলেও ৬ মাস বা এক বছরের তথাকথিত প্রশিক্ষণ দিয়ে হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। যখন-তখন নার্সরা চাকরি হারাচ্ছে। কোভিড-১৯ এর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রণীত নীতিমালাও অনেক বেসরকারি হাসপাতাল মেনে চলছে না। ফলে নার্সরা বেসরকারি হাসপাতালে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে কাজ করছেন।

কুয়েত সরকার বাংলাদেশ থেকে নার্স নেয়ার প্রস্তাবনাটি কে আমরা ফেরত দিয়ে দিয়েছি। এক্ষেত্রে কোভিড-১৯ দোহাই দেয়া হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত নার্সদের আমরা সেই ভাবে কাজে লাগাতে পারছি না।

বর্তমানে সারা বিশ্ব ভারতীয় এবং ফিলিপিনো নার্সরা তাদের কর্ম দক্ষতা দিয়ে একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। আমাদের নার্সদের ও দক্ষতার অভাব নেই। কিন্তু কিছু অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত আমাদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছে।

আমরা না পারছি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে নার্সদেরকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কাজে লাগাতে, না পারছি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে।

একজন শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গিয়ে তার যাওয়ার খরচ তোলার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। চার/ পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে সে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে।
কিন্তু নার্সের মত একটি দক্ষ পেশাজীবী অল্প কয়েক মাসেই তার যাওয়ার খরচ তুলে দেশকে বৈদেশিক মুদ্রা দিতে পারতো। অথচ এই অবধারিত সুযোগ পেয়ে আমরা হাতছাড়া করছি কেন? এটা আমাদের পূনরায় বিবেচনা করা উচিৎ।

মাত্র ৫০০ জন নার্স পাঠালে বেসরকারি খাত থেকে আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি হত না।
বেসরকারি খাতে কম বেতন পাওয়ার যে আক্ষেপ নার্সদের মধ্যে ছিল এই সুযোগটি যদি আমরা গ্রহণ করতে পারতাম তাহলে তাদের হতাশা কিছুটা হলেও কাটতো। বাংলাদেশের নার্সিং পেশা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যাওয়ার একটি সুন্দর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হল।
কিন্তু সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। মন্ত্রণালয়ের এবং ডিজিএনএম এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ যদি বিষয়টিকে একটু নতুনভাবে চিন্তা করেন তাহলে কিন্তু কুয়েত কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের বেসরকারি খাতের নার্সদেরকে সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারেন।

এই ব্যাপারে নার্সিং সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দকে এগিয়ে আসতে হবে; বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে বেসরকারি নার্সদেরকে সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন। এতে করে বিদেশের মাটিতে দেশের দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানির দিকে আরেকধাপ অগ্রসর হবে। বাংলাদেশী দক্ষ পেশাজীবিদের জন্য বিদেশের শ্রমবাজার উন্মোক্ত হবে এবং জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।

এ ব্যাপারে সকল কর্তৃপক্ষের আশু পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

চৌধুরী আহসানুল হায়দার
প্রভাষক ও কলামিস্ট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here