নার্সিং পেশা ও আমার বাবার কথা- ডা. ফেরদৌস খন্দকার

নাসিং পেশাটা আমার কাছে কখনোই পছন্দের না। নার্সদের কাজটা কি, যখন থেকে বুঝতে শিখলাম; তখন থেকেই এই পেশা আমার অপছন্দ। বিশেষ করে মেডিসিন প্রশিক্ষণের সময় নার্সদের কাজ হাড়ে হাড়ে দেখলাম, বুঝতেও পারলাম। রোগী সম্পর্কিত এমন কোন কাজ নেই, যেটা করতে হয় না। ওষুধ প্রস্তুত করা, ওষুধ খাওয়ানো, স্টেশনে কি হচ্ছে, রোগীর আত্মীয় কি করলো, রোগী বাথরুমে যেতে চায়, গোসল করানো কত কি! ঠিক তখন থেকেই এই নার্সিং পেশার প্রতি আমার বিতৃষ্ণা।

৮ ঘন্টার শিফটে তাদেরকে কাজ করতে হয় ১২ ঘন্টা। পেশার দিক থেকে বিবেচনা করলে, পজিটিভ কিছুই পাইনি এর মধ্যে। তাই যখনি কাউকে দেখি নার্সিং পড়তে, আমার আত্মীয় স্বজন, বন্ধুদেরকে; সবাইকে নিরুৎসাহিত করি, কারণ মাত্রারিক্ত কাজ। অথচ কোন ধরণের সন্তুষ্টি নেই। অন্যদিকে ডাক্তারদের কাজ অনেক সহজ। মাথা খাটাবে কোনভাবে, এরপর একটি আদেশ দিয়ে চলে যাবে। ঐ কাজটাও নার্সকে করতে হবে।

তবে গতকাল বিষয়টা একটু অন্যভাবে বুঝতে পারলাম। বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ্য হয়ে পড়লেন। বাবার পাশে থাকতে হবে। মায়েরও বয়স হয়েছে। ফলে দায়িত্ব কাঁধে নিলাম। বাবার পাশে অনেকদিন পর পুরো রাত শুয়ে থাকলাম। সেই ছোটবেলায় সবশেষ কবে ঘুমিয়েছি মনেই পরে না। কাল রাতে বাবাকে আমার পাশে শিশু হিসেবে দেখলাম। প্রতি ঘন্টায় দেখি উঠে যেতে চায়। হাঁটতে চায়। যদিও তার দু’টি পা বেশ দূর্বল। বাথরুমে যেতে চায়। পাঁচঘন্টার রাতে উনি টয়লেটে গেলেন চারবার।অসুবিধা নেই, তবুও তিনি যাবেন। গিয়ে বসে থাকবেন। কাপড়ও নষ্ট হলো। তবে কি কারণে যেন তার মন খারাপ হলো না। কোমড়ে পেচিয়ে রেখেছেন লুঙ্গি। কিন্তু জিজ্ঞেস করছেন, লুঙ্গিটা কোথায়? কাপড়ের দিকে তাকিয়ে বলছেন, এটা কেনো ভিঁজলো? শিশু বেলায় আমিও নিশ্চয়ই এই মানুষটার সাথে এমনটাই করেছি। কাল নিজে চেয়ে চেয়ে দেখলাম, বাবা যখন শিশু হয়; সেই শিশুটিকে। বুঝতে পারছেন না কিছুই। সকালে ঘুম থেকে উঠে বলে ফেললো, দুপুরে বন্ধুর সাথে আড্ডা দেয়ার অ্যাপয়েনমেন্ট আছে। আমি আর মা দু’জনেই হাসলাম। দেখো, “বুড়া দুপুরের আড্ডাটাও মিস করতে চাচ্ছে না”! অথচ উনি জানেনও না একটু পরে উনাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি আমরা। হাসপাতাল থেকে নামার সময়ও একই কথা, দুপুরের অ্যাপয়েনমেন্টটা কি হবে? মনটা গভীর বিষাদে ঢেকে গেলো।

আজ হাসপাতালে ডাক্তারবাবু ফোন দিয়ে বললো “চাচা তো সুযোগ পাইলেই পাশে বসায়ে আমাকে কোরান হাদিস শিখাচ্ছে”বাবার জীবনের নতুন যাত্রা বোধ হয় এখান থেকেই শুরু হয়ে গেলো। সারাজীবন যে মানুষটাকে দেখেছি অনেক কর্মক্ষম, সেই মানুষটি আজ এভাবে অক্ষম, পরনির্ভরশীল হয়ে পড়লেন!

আজ আবার নতুন করে নার্সিং পেশাকে আবিস্কার করলাম যখন ডাক্তারির সাথে নার্সিংটা যোগ হলো।নিজেদের কেউ না, অথচ কত মমতায় নার্সরা মানুষদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বুঝলাম, সবকিছু অর্থমূল্য দিয়ে বিবেচনা করা যায় না; করা ঠিকও না। বাবার খারাপ সময়ে বুঝলাম, নার্সিং পেশাটা কত মহান। আসলে প্রয়োজন দিয়েই অনেক সময় অনেক কঠিন সত্যকে আবিস্কার করতে হয়। নার্সদেরকে স্যলুট জানাই আর দোয়া চাই প্রিয় বাবার জন্যে।

 

 

 

 

 

লেখকঃ
ডা. ফেরদৌস খন্দকার
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ- নিউইয়র্ক
প্রেসিডেন্ট- শেখ রাসেল ফাউন্ডেশন ইউএস
ফেলো ও গবেষক- আমেরিকান কলেজ অব ফিজিশিয়ানস

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here