ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল

ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ( পর্ব- ১)


ড. অনির্বাণদিপ বোস
এম ফার্ম, পিএইচডি
গ্রুপ লিডার
টাব বায়োস্টাডি সার্ভিসেস
ইন্ডিয়া
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ কথাটি এখনকার দিনে সংবাদমাধ্যমে খুব শোনা যাচ্ছে। করোনা প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিয়ে সাধারণ মানুষ এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝেও ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে। নতুন ওষুধ তৈরি অথবা ভ্যাকসিন তৈরি ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ভূমিকা অনস্বীকার্য কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এখনো আমাদের মধ্যে স্বচ্ছ কোন ধারণা নেই। ফলশ্রুতিতে সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণী আমাদেরকে জেনে বুঝে ভুল পথে পরিচালিত করছে।
তাই এখনকার এই বিশেষ পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে আমি স্বল্প পরিসরে আলোচনা করব।
ক্লিনিকাল ট্রায়াল কি?
প্রথমেই আমরা সহজ ভাষাতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ব্যাপারটি বুঝে নেব। ওষুধ বিজ্ঞানীদের বছরের পর বছর নিরন্তন গবেষণা ও প্রচেষ্টার ফলে নতুন ওষুধ অথবা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়।
ওষুধ অনুমোদিত সংস্থা যা সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। একটি ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিস্কারের পরপরই কখনোই তা বাজারে আসার অনুমোদন পায় না। ভ্যাকসিন, ওষুধ বাজারে আসার আগে তাকে মানব শরীরের উপর প্রয়োগ করে তার গুনাগুন বিচার করা হয়। ওষুধ বিশেষজ্ঞরা সুস্থ অথবা অসুস্থ মানুষের উপরে প্রয়োগ করে সংশ্লিষ্ট ওষুধ বা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে নেন। তাছাড়াও উক্ত ওষুধটি মানব শরীরে কি ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে তাও তারা দেখে নেন। সব কিছু দেখার পর ওষুধ ভ্যাকসিন অনুমোদনকারী সংস্থা যদি মনে করে যে ওষুধটি বা ভ্যাকসিনটি মানব শরীরে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না অথবা রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা প্রমাণিত হয় তখনই কেবল ওষুধটি বা ভ্যাকসিনটি বাজারজাতকরণের চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। মানব শরীরে এই ধরনের পরীক্ষামূলক ভাবে ওষুধ বা ভ্যাকসিন প্রয়োগকে আমরা সহজ ভাষায় ক্লিনিকাল ট্রায়াল বলতে পারি।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বিভিন্ন ধাপসমূহ(Phases):
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
সাধারণত কয়েকটি পর্যায়ের মাধ্যমে এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পাদিত হয়। প্রতিটি পর্যায়ে বা ধাপে গবেষকদের অনেক ধৈর্যশীলতার সাথে কাজ করতে হয়। এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর বিভিন্ন পর্যায়গুলি একটু বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ক্লিনিকাল ট্রায়াল 0 এর পর্যায় :
ক্লিনিকাল ট্রায়াল 0 এর পর্যায় এ খুব অল্প সংখ্যক লোকের উপর (সাধারণত ১৫এর চেয়ে কম) করা হয় । এই পর্যায়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল গবেষকরা পরে পর্যায়ক্রমে উচ্চ মাত্রায় ওষুধ ব্যবহার করা শুরু করার আগে এটি মানুষের পক্ষে ক্ষতিকারক না– তা নিশ্চিত করার জন্য ওষুধের খুব অল্প মাত্রা ব্যবহার করেন ।
প্রথম পর্বে কী ঘটে?
ক্লিনিকাল ট্রায়ালের প্রথম ধাপের সময় গবেষকরা প্রায় ২০ থেকে ৮০ জন সুস্থ লোকের উপর ওষুধের প্রভাবগুলি দেখতে বেশ কয়েক মাস ব্যয় করেন । এই পর্বে লক্ষ্য করা হয় যে, গুরুতর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ছাড়াই মানুষ সর্বোচ্চ কত ডোজ পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারে। এখানে মানব দেহের উপর ওষুধ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় তা তদন্তকারীরা খুব ঘনিষ্ঠভাবে অংশগ্রহণকারীদের নিরীক্ষণ করেন। প্রাক-গবেষণামূলক গবেষণা (Pre-clinical)সাধারণত ডোজ সম্পর্কে কিছু সাধারণ তথ্য সরবরাহ করে। তবে মানবদেহে কোনও ওষুধের প্রভাব অপ্রত্যাশিত হতে পারে। সুরক্ষা এবং আদর্শ ডোজ মূল্যায়ন ছাড়াও তদন্তকারীরা ওষুধ গ্রহণ করার সর্বোত্তম উপায় অর্থাৎ ওষুধটি ওরাল না ইন্ট্রাভেনাস কি ভাবে নেওয়া যাবে তা ঠিক করেন। প্রথম পর্যায় থেকে ৭০ শতাংশ ওষুধ দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার অনুমতি পায়।
দ্বিতীয় পর্বে কী ঘটে?
ক্লিনিকাল পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপে কয়েক শতাধিক অংশগ্রহণকারীকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যুক্ত করা (অবশ্যই তাদের সম্মতি সাপেক্ষে) হয় যারা ওই রোগটিতে ভুগছেন অর্থাৎ যে রোগটির জন্য ওষুধটির পরীক্ষা চলছে। এই পর্যায়ের পরীক্ষাতে অসুস্থ রোগীদের সাধারণত একই ডোজ দেওয়া হয় যা পূর্ববর্তী পর্যায়ে নিরাপদ বলে মনে হয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা ওষুধটি কতটা কার্যকর তা দেখতে এবং ওষুধটির কারণে হতে পারে এমন কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য অংশগ্রহণকারীদের বেশ কয়েক মাস বা বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করেন।
দ্বিতীয় ধাপে পূর্বের পর্যায়গুলির তুলনায় বেশি অংশগ্রহণকারী জড়িত যদিও এটি এখনও কোনও ওষুধের সামগ্রিক সুরক্ষা প্রদর্শন করার মতো যথেষ্ট নয়। যাইহোক, এই ধাপের সময় সংগৃহীত তথ্য ও উপাত্ত গবেষকদের তৃতীয় ধাপ পরিচালনার পদ্ধতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। সাধারণত এই পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ ওষুধ তৃতীয় ধাপে এগিয়ে যায়।
তৃতীয় ধাপে কী ঘটে?
ক্লিনিকাল পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে সাধারণত ৩,০০০ জন অংশগ্রহণকারী ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর সাথে যুক্ত হয় যারা ওই রোগটিতে ভুগছেন যে রোগটির জন্য ওষুধটির পরীক্ষা চলছে। এই পর্যায়ের ট্রায়ালগুলি বেশ কয়েক বছর ধরে চলতে পারে।
তৃতীয় পর্বের উদ্দেশ্য পুরানো ওষুধের তুলনায় নতুন ওষুধ কীভাবে কাজ করে তা মূল্যায়ন করা। বিচারের সাথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, তদন্তকারীদের প্রমাণ করতে হবে যে ওষুধটি অন্তত বিদ্যমান চিকিত্সার বিকল্প হিসাবে নিরাপদ এবং কার্যকর।
এটি করতে, তদন্তকারীরা Randomisation নামে একটি প্রক্রিয়া ব্যবহার করেন। এর মধ্যে নতুন ওষুধ গ্রহণের জন্য কিছু অংশগ্রহণকারীকে এলোমেলোভাবে বেছে নেওয়া হয়।
তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালগুলি সাধারণত ডাবল-ব্লাইন্ড হয়, যার অর্থ অংশগ্রহণকারী বা তদন্তকারী উভয়ই জানেন না যে অংশগ্রহণকারী কোন ওষুধ গ্রহণ করছে। এটি ফলাফল ব্যাখ্যা করার সময় পক্ষপাত নির্মূল করতে সহায়তা করে।
অংশগ্রহণকারীদের বিরল এবং দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলি এই পর্যায়ে প্রদর্শিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
তদন্তকারীরা যদি দেখেন যে ওষুধগুলি ইতিমধ্যে বাজারে থাকা অন্যদের মতো কমপক্ষে নিরাপদ এবং কার্যকর, তবেই সরকারি সংস্থা সাধারণত ওষুধটি অনুমোদন করে।
চতুর্থ পর্যায়ে কী ঘটে?
ওষুধ অনুমোদনের পরে চতুর্থ পর্যায়ের ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলি ঘটে। এই পর্বে হাজার হাজার অংশগ্রহণকারী জড়িত এবং বহু বছর ধরে চলতে পারে। তদন্তকারীরা ওষুধের দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা, কার্যকারিতা এবং অন্য কোনও সুবিধা সম্পর্কে আরও তথ্য পেতে এই পর্বটি ব্যবহার করেন।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রতিবন্ধকতা:
ক্লিনিকাল ট্রায়াল শেষ করতে সবচেয়ে বড় বাধা হল অংশ গ্রহণকারীদের অভাব। কিছু ড্রাগ পরীক্ষার জন্য রোগীদের রোগের বৈশিষ্ট্যের অস্বাভাবিক সংমিশ্রণ প্রয়োজন। উপযুক্ত রোগীদের সন্ধান করা এবং তাদের সম্মতি গ্রহণ করা একটি চ্যালেঞ্জ, বিশেষত যখন তারা সরাসরি কোনও লাভ না পান (কারণ তাদের অর্থ প্রদান করা হয় না, অধ্যয়নের ওষুধটি এখনও কাজ করে প্রমাণিত হয়নি। ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ক্যান্সারে আক্রান্ত 5% এরও কম প্রাপ্ত বয়স্করা ড্রাগ পরীক্ষায় অংশ নেন।
বায়ুবাহিত অ্যালার্জি, মৌসুমী অনুষঙ্গ ডিসঅর্ডার, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং ত্বকের রোগ এর সম্ভাব্য জড়িত ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলির জন্য গবেষণাটি বছরের একটি সীমাবদ্ধ অংশে করা হয়।
ভ্যাকসিন গাইডেন্সের ক্লিনিকাল মূল্যায়ন:
ভ্যাকসিনগুলির ক্লিনিকাল মূল্যায়নের বিষয়ে ডাব্লুএইচওর (WHO)নির্দেশিকা ২০০১ সালে অনুমোদিত হয়েছে। ডাব্লুএইচও কর্তৃক বিকাশিত গাইডলাইন ছাড়াও ভ্যাকসিনগুলির ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলির বিভিন্ন দিক সম্পর্কিত গাইডলাইনগুলি নিয়ামক সংস্থাগুলি থেকে পাওয়া যায় যেমন:
International Conference on Harmony (ICH),
European Agency for the Evaluation of Medicinal Products (EMEA),
The United States Food and Drug Administration (FDA)।
সারাবিশ্বেই বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের জন্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অতীতেও হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো বেশি হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। উন্নত বিশ্ব প্রতিযোগিতায় নেমেছে কার আগে কে ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করবে, কে আগে আন্তর্জাতিক বাজারে আধিপত্য বিস্তার করবে। এই প্রতিযোগিতাটি অনেক সময় অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়। ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার এর সাথে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত তাদেরকে অবশ্যই নীতি-নৈতিকতার মধ্য থেকেই কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। সবার একটি কথাই মনে রাখতে হবে মানব সেবাই পরম ধর্ম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here