অতিরিক্ত রোগীর চাপ- বিঘ্নিত চিকিৎসা- নার্সিং সেবা: উত্তরণের উপায় কি?

চৌধুরী আহ্সানুল হায়দার

চৌধুরী আহ্সানুল হায়দার

স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম। বাংলাদেশের সংবিধানের সুস্পষ্ট ভাবে স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সরকার দেশের মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে অনেক বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তৈরি করেছেন। হাসপাতালে জনবল নিয়োগের জন্য প্রতিবছর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে ডাক্তার- নার্স নিয়োগ করা হচ্ছে। কেনা হচ্ছে অনেক মূল্যবান মেশিনারি এবং যন্ত্রপাতি। কিন্তু এত কিছুর পরও হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
হাসপাতালগুলোতে রোগীর উপচে পড়া ভিড় এর অন্যতম একটি প্রধান কারণ।
যেকোন দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ হল কিউরেটিভ(চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো করা) , প্রিভেন্টিভ ( রোগপ্রতিরোধের সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা) আর প্রমোটিভ( যারা ভালো আছে তাদেরকে আরো ভালো রাখা)
কিন্তু আমাদের দেশের স্বাস্থ্য সেবা খাতে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে কিউরেটিভ শাখাকে। অর্থাৎ, আমরা কোন রোগী আসলে তাকে সুস্থ করে তুলে দায়িত্ব সম্পন্ন করছি এবং বাহবা কুড়াচ্ছি। হাসপাতালে লোকবল নিয়োগ করে, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি যে আমরা দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতকে উৎকর্ষতার চরম শিখরে পৌছে দিচ্ছি। কিন্তু বাস্তবে কি তাই?
বাস্তবে আমাদের দেশের হাসপাতালের চিত্র কি রকম? এ বিষয়ে আমারে আমাদের সবারই ধারণা আছে তারপরও একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
আমাদের দেশের প্রধান প্রধান সরকারি হাসপাতালে উপচে পড়া রোগীর ভিড়। রোগীর বিছানায় রোগী আছে, ফ্লোরে রোগী আছে, বারান্দায় রোগী আছে, করিডোরে রোগী আছে।
রোগী কোথায় নেই? সবখানেই রোগী আছে। একটা বেডে একজন রোগী থাকার কথা থাকলেও সেখানে কমপক্ষে দুইজন রোগী থাকছে। রোগীর অত্যাধিক চাপের কারণে চিকিৎসকরা ভালোভাবে সেবা দিতে পারছেন না, নার্সিং প্রফেশনালরা যথাযথভাবে নার্সিং করতে পারছেন না। রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চার-পাঁচ ঘণ্টা পরেও ডাক্তার -নার্স এসে রোগীকে দেখছেন না। এধরনের অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। রোগীর প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার কারণে ওষুধ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি সরবরাহে বিলম্ব হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রতুলতা দেখা দিচ্ছে। হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। রোগের চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
কিন্তু এসব থেকে উত্তরণের উপায় কি?
আমরা আসলে প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ব্যার্থ হচ্ছি যে কারণে মানুষ হাসপাতালগুলোতে ভিড় করছে।
সময় এসেছে নতুন করে সবকিছু পর্যালোচনা করার। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে আমাদেরকে নতুন করে কর্মপরিকল্পনা নিয়েই কাজ করতে হবে। সত্যিকার অর্থে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে–
১. জেলা জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। জেলা জনসাস্থ কেন্দ্রের প্রধান হবেন কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। জেলা পাবলিক (কমিউনিটি হেলথ নার্স) হেলথ নার্স হবেন এই কেন্দ্রের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড।
তাদের দুজনের নেতৃত্বে প্রত্যেক জেলাতে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের প্রিভেন্টিভ এবং প্রমোটিভ শাখা পরিচালিত হবে। এই কেন্দ্রটি সম্পূর্ণ সিভিল সার্জনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকবে।
২. উপজেলা পর্যায়ে কমিউনিটি মেডিসিন সহকারী অধ্যাপক জনস্বাস্থ্যের নেতৃত্বে থাকবেন।
৩. তাদের মেইন কাজ হবে পরিবার পরিকল্পনা নিশ্চিতকরন, মা ও শিশু স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরন, রোগ প্রতিরোধ মূলক জনসচেতনতা তৈরি, ধূমপান মদ্যপান ইত্যাদির বিরুদ্ধে সারাবছর প্রচারাভিযান চালানো, প্রতিটি সরকারি বেসরকারি স্কুল কলেজ পরিদর্শন এবং স্বাস্থ্য সেবা প্রতিরোধ মূলক সেবা এবং উন্নত করণ সেবা প্রদান নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
৪. ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া এই টিমের কাজ হবে।
৫. পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা, অন্যান্য মাঠকর্মী যারা আছেন তারা সবাই এই টিমের অধীনে কাজ করবেন।
৫. উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং জেলা সিভিল সার্জন শুধুমাত্র কিউরেটিভ দিকটি দেখবেন। প্রমোটিং এবং প্রিভেন্টিং দায়িত্ব থেকে তাদের অব্যাহতি দিতে হবে। কারণ এতগুলো দায়িত্ব একসাথে পালন করতে গিয়ে আসলে প্রিভেন্টিভ এবং কিউরেটিভ কাজগুলো করা হয় না। ফলে যেহেতু আমরা তৃনমূল পর্যায়ে রোগ চিহ্নিত করতে পারিনা যে কারণে হাসপাতালে পরবর্তীতে রোগীর ভিড় লেগে যায়।
৬. প্রয়োজনে আলাদাভাবে কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের জন্য এবং কমিউনিটি হেলথ নার্স এর জন্য আলাদা বিসিএস এর মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগ প্রদান করতে হবে। এতে করে তাদের পেশাদারিত্ব, দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাবে। এই পেশার লোকজন সিভিল সার্জন অফিসের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে সম্পূর্ণভাবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং সরাসরি ডিজে হেলথে রিপোর্ট করবেন।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, হাসপাতালগুলোকে আমাদের বাঁচাতে হবে। বর্তমানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সারা বছর ব্যাপী আমাদের যে প্রমতিভ এবং প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম নেয়ার কথা সেটা উপজেলা পর্যায়ে নেয়া হচ্ছে না ফলে রোগীর চাপ হাসপাতালগুলোতে বেড়ে যাচ্ছে। এরূপ রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে ও ব্যবস্থাপনা তৈরি হচ্ছে।
উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলো নিতে পারলে স্বাস্থ্যসেবা খাতে গুণগত পরিবর্তন আসবে বলে বিশ্বাস।

চৌধুরী আহ্সানুল হায়দার
এনজিও কর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here