তদন্ত কর্মকর্তার সাথে প্রমোদ ভ্রমণে অভিযুক্ত ওয়ার্ডবয়

বগুড়ায় যৌন হেনস্থার শিকার নার্স

 

অনুসন্ধানী প্রতিবেদক
প্রকাশঃ ১৬.০০ ২৯ মার্চ ২০২৩ 
মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল, বগুড়ার  এক নার্স গত বছর ওয়ার্ড মাস্টারের দায়িত্বে থাকা ওয়ার্ড বয়ের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানীর অভিযোগ করেছিলেন। পাঁচ দিনের মধ্যে সেই অভিযোগের তদন্তের কথা ছিল। এরপর কেটে গেছে ১১২ দিন। তদন্তের নামগন্ধও আর দেখা যায়নি। বরং অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে নিয়ে প্রমোদ ভ্রমণে গিয়েছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. শফিক আমিন কাজল। হয়রানির প্রতিবাদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়ার অপরাধে উল্টো শোকজ পেতে হয়েছে সেই নার্সকে। আর বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে অভিযুক্ত সেই ওয়ার্ড মাস্টার।

https://fb.watch/jzNDEWy0GK/

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া নার্স এর সাক্ষাতকার এর লিংক

অভিযুক্ত ওয়ার্ড মাস্টারের নাম শহিদুল ইসলাম সুইট। তিনি বগুড়া শহরের ফুলবাড়ি এলাকার বাসিন্দা। তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানীর এই অভিযোগ করা হয় ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর। অভিযোগটি গ্রহণ করেন মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. নুরুজ্জামান সঞ্চয়। তিনি ১২ ডিসেম্বরে ৫ কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানো নোটিশ দেন সুইটকে। আর ১৪ ডিসেম্বর পাঁচ সদস্য নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করে দেন হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক।

এই বোর্ড সদস্যরা হলেন, হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট রফিকুল ইসলাম, আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা (আরএমও) শফিক আমিন কাজল, আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা (আরএমও) একেএম খায়রুল বাসার, সেবা তত্ত্বাবধায়ক মোছা. আফরোজা আখতার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা একরাম হোসেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘ওয়ার্ডমাস্টার শহিদুল ইসলাম সুইট ওই নার্সের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে বাজে মন্তব্য করেন। তিনি ওই নার্সকে বলে-হাজি সেজেছে, সারাজীবন খারাপ কাজ করে এখন হাতে মুজা, পায়ে মুজা পরে মানুষকে দেখায়। এখনই খারাপ কাজের প্রস্তাব দিলে কাপড় খুলে আবার খারাপ কাজ করবে।.. ’

বিষয়টি ওই নার্স তার স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করেন। বিষয়টি নিয়ে শহিদুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করেন নার্সের স্বামী। এ ঘটনার পরেরদিন অফিস চলাকালীন অবস্থায় শহিদুল ইসলাম এসে নার্সকে গালি গালাজ করে। এমনকি মারধরের চেষ্টাও করেন শহিদুল।

তবে চাঞ্চল্যের বিষয়, অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ে বোর্ড গঠনের তিন মাস পার হলেও কোনো তদন্তই হয়নি। এটা নিয়ে একাধিকবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুরাহা পাননি অভিযোগকারী নার্স। এর মধ্যে চলতি ২৪ মার্চ একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে শহিদুল ইসলামের যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে বক্তব্য দেন ওই নার্স।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ এই নার্সের বিরুদ্ধে একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেন তত্ত্বাবধায়ক ডা. নুরুজ্জামান সঞ্চয়। এতে উল্লেখ করা হয়, আপনার অভিযোগের তদন্তাধীন বিষয়ে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে সোশ্যাল

মিডিয়ায় অবহিত করেছেন। এবং উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছেন যা সরকারি চাকরিবিধি ২০১৮ সালের পরিপন্থী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

হাসপাতাল প্রশাসন এ নোটিশে পাঁচ কার্য দিবসের মধ্যে কারণ জানতে চান ওই নার্সের কাছে থেকে। কিন্তু যে অভিযোগের ভিডিও প্রচারের জন্য তাকে নোটিশ করা হয়, অজ্ঞাত কারণে সেটির অগ্রগতি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই হাসপাতালে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সময়ের অভাবে তারা তদন্ত কার্য শুরু করতে পারেননি। আর পরবর্তীতে ওই ভিডিও দেয়ার কারণে কেউ তদন্ত করতে চাচ্ছেন না।

এসব কথা জানান মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক নুরুজ্জামান সঞ্চয়। তিনি বলেন, নার্সের করা যৌন হয়রানির অভিযোগটি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু কমিটি সময়ের অভাবে তদন্ত কাজ আগায়নি। এর মধ্যে ওই নার্সের একটা ভিডিও প্রচার হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তারা কমিটিতে থাকতে চাচ্ছেন না। তারা নাম প্রত্যাহার করে নিতে চাচ্ছেন।

এরই মধ্যে চলতি মাসে শহিদুল ইসলাম কক্সবাজার, বান্দরবানে বেড়াতে যান। ভ্রমণে তার সঙ্গী ছিলেন তদন্ত কমিটির এক সদস্য ডা. শফিক আমিন কাজল। শহিদুল ইসলাম সুইট নিজের ফেসবুক থেকে তাদের ভ্রমণের ছবি পোস্ট করেন।

ঘটনা এমন হলে এই কমিটির কাছ থেকে কীভাবে সঠিক রিপোর্ট পাওয়া যাবে, এমন প্রশ্ন রেখে অভিযোগকারী সেই নার্স বলেন, তিন মাসের বেশি হয়ে গেছে আমার অভিযোগের। এখন পর্যন্ত আমার সাক্ষ্য নেয়া হয়নি। হাসপাতালে চাকরি করতে অনিরাপদ বোধ করি। আবার আমার পাশে যারা দাঁড়িয়েছেন তাদেরকেও হুমকি-ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। অভিযোগ দিয়ে বরং চাকরি নিয়ে টানাটানিতে পড়েছি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া ভিডিওর বিষয়ে অভিযোগকারী আরও বলেন, আমার সঙ্গে যা ঘটেছে তাই বলেছি। আর সুইট তো হাসপাতাল থেকে বিভিন্নভাবে আয় করেন। এটা সবাই জানেন। তার অ্যাম্বুলেন্স আছে। ইমপালস হাসপাতালে অংশীদার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহিদুল ইসলামের সুইটের বাবা মোহাম্মদ আলী হাসাপাতালের অ্যাম্বুলেন্সচালক ছিলেন। বাবার পরে তিনি হাসপাতালে চাকরি নেন। সুইটের নামে মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল এলাকায় দুইটি অ্যাম্বুলেনস চলে। ঠনঠনিয়া এলাকায় সম্প্রতি চালু হওয়া ইমপালস নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালেও অংশ আছে তার।

শহিদুল ইসলাম সুইটের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রসঙ্গে ১২৮ জন নার্স স্বাক্ষর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছেন। এখানে স্বাক্ষর করা নার্সদের মধ্যে পাঁচ জন জানান, সুইট হাসপাতালের সবকিছুতে প্রভাব খাটান। তিনি নার্স, মেডিক্যাল টেকনিশিয়ানদের ইন্টার্নি করার সুযোগ দিয়ে টাকা আদায় করেন। ওই নার্সের অভিযোগে স্বাক্ষর দেয়ার কারণে সুইটের পক্ষের লোকজন বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখান।

অভিযুক্ত শহিদুল ইসলাম সুইট বলেন, ‘ভাই উনি অভিযোগ করেছিলেন। সেটা একটা আপোসের মধ্যে চলে এসেছিল প্রায়। কিন্তু এর মধ্যে তিনি একটি ভিডিও দেন ফেসবুকে। উনি যেসব অভিযোগ করছেন সেগুলো সত্য নয়। আমি শুধু চাকরি করি,  আমার অ্যাম্বুলেন্স নেই।অন্য কোনো ব্যবসা নেই।’

তদন্ত কমিটির সদস্য তত্ত্বাবধায়ক সেবা আফরোজা আখতার সম্প্রতি অবসরে চলে গেছেন। তিনি জানান, চাকরিতে থাকা অবস্থায় ওই তদন্তে কয়েক জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। তবে শহিদুল ইসলামের সাক্ষ্য নেয়া বাকি ছিল। এরপর ২৭ ফেব্রুয়ারি অবসরে চলে আসি। এখন আমার ওই পদে যিনি আছেন তিনিই তদন্তের দায়িত্বে থাকবেন।

তদন্ত কমিটির প্রধান মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তার দাবি, তদন্ত চলমান না থাকলে যে নার্স অভিযোগ দিছে, সে কীভাবে সাক্ষ্য দেয়? এ ছাড়াও তদন্তের সময়সীমা বাড়িয়ে নেয়ারও দাবি করেন ডা. রফিকুল ইসলাম।

তবে কবে সাক্ষ্য নিয়েছেন এবং তদন্তের সময়সীমা জানতে চাইলে ডা. রফিকুল বলেন, সেটা তাকেই (নার্স) জিজ্ঞেস করেন। আমার এখন মনে নেই।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here