রোজায় গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা : করণীয় ও বর্জনীয়

ডা.শাইখ ইসমাইল আজহারী

পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম সাধনা করা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম একটি স্তম্ভ। শর্তসাপেক্ষে প্রাপ্তবয়স্ক সকল নারী পুরুষের উপর রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ।

প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১৬০ কোটি মুসলিম রমজান মাসে সিয়াম সাধনা পালন করেন। বিশ্বের কোথাও ১৬ ঘণ্টা থেকে কোথাও ১৮ ঘণ্টা আবার কোথাও ২১ ঘণ্টা পর্যন্ত রোজা পালন করা হয়।
বছরে এক মাস রোজা রাখার অনেক স্বাস্থ্যগত উপকারিতা ইতিমধ্যে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।ইসলাম মধ্যপন্থী ধর্ম। জোর করে কারো উপর কোন বিধান ইসলাম চাপিয়ে দেয় নাই। তাইতো ইসলাম যেভাবে রোজা রাখার আদেশ দিয়েছে সাথে সাথে অসুস্থ ব্যক্তির জন্য কিংবা মুসাফিরের জন্য রোজা ভাঙ্গার অনুমতি প্রদান করেছে।
এখানে আমি গ্যাস্ট্রিকের রোগীদের জন্য রোজায় এসিডিটির সমস্যা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করব।

রোজার সময় খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন বেশি বেশি শোনা যায় যে রোজা রাখলে এসিডিটির কোন সমস্যা হবে কিনা কিংবা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার রোগীর জন্য রোজা রাখলে কোন অসুবিধা হবে কিনা?
এখানে দুটো বিষয় খুব ভাল করে বুঝতে হবে আমাদের।

প্রথমে আমরা গ্যাস্ট্রিক রোগ সমপর্কে কিছুটা বেসিক ধারণা নিই। মানবদেহের পাকস্থলী তে প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দুই লিটার হাইড্রোক্লোরিক এসিড ক্ষরিত হয়, যার কাজ হচ্ছে পাকস্থলীতে খাবার পরিপাক করতে সহায়তা করা।যদি কোন কারণে পাকস্থলীতে এই হাইড্রোক্লোরিক এসিড ক্ষরণ এর মাত্রা বেড়ে যায় তাহলে পাকস্থলীর অভ্যন্তরীণ আবরণ তথা মিউকাস মেমব্রেনে প্রদাহ তৈরি হয় যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় গ্যাসট্রাইটিস বলে। অতিরিক্ত খাবার খেলে কিংবা অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে কিংবা বেশি বেশি তৈলাক্ত খাবার খেলে পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে যায় এবং প্রদাহ হয় যাকে আমরা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে থাকি।

গ্যাস্ট্রাইটিস এর উপসর্গঃ

১.পেটের উপরি অংশে ব্যাথা হবে।
২.বুক জালা পোড়া করবে।
৩. খাবারের আগে পরে পেট ব্যাথা হতে পারে।
৪.খাবার এর সময় বুকে বাঁধ পড়ার মত অনুভব হবে।
৫. ঢেকুর আসবে।
৬. বমি বমি ভাব থাকবে, এবং খাবারের চাহিদা কমে যাবে।
৭. অল্প খাবারেই পেট ভরে গেছে মনে হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে একজন সুস্থ মানুষ রোজা রাখলে তার এসিডিটি হবার কোন সমস্যা আছে কিনা যদি এক কথায় আমরা উত্তর দেই তাহলে বলতে হয় যে একজন সুস্থ মানুষ রোজা রাখলে তার এসিডিটি হবার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই যদি সে ইফতারি ও সাহরিতে নিম্নোক্ত নিয়ম গুলো মেনে চলে।

ইফতারির সময় যা করতে হবে :

১. ইফতারিতে অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার কিংবা তেলে ডুবিয়ে যেইসব খাবার তৈরি করা হয় যথা পেয়াজু, আলুর চপ, বেগুনি, চিকেন ফ্রাই, জিলাপি ইত্যাদি যতটুকু সম্ভব পরিহার করতে হবে।
২.একসাথে অনেক বেশি খাবার খেয়ে ফেলা যাবে না। অনেকে ইফতারিতে বসেই খেতে খেতে ইসোফেগাস তথা গলবিল পর্যন্ত খেয়ে ফেলে তা কখনোই করা যাবে না।
৩.ইফতারীতে ইসুপগুলের শরবত, ডাবের পানি, ইত্যাদি খাওয়া যাতে পারে আর শর্করা জাতীয় খাবার যথা খেজুর, পেয়ারা, ছোলা, সেমাই ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
৪. ইফতারি হতে হবে লাইট মিল কিংবা অল্প পরিমান খাবার তারপর মাগরিবের নামাজ পড়ে রাতের খাবার খেয়ে নেয়া ভাল। সম্ভব হলে তারাবীর নামাজের আগেই খেয়ে নিতে হবে।তাহলে খাবারের পরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে নামাজ পড়তে গেলে নামাজের সময় এক প্রকার ব্যায়াম হয়ে যাবে এবং সেটা খাবার পরিপাকের ক্ষেত্রে সহায়ক সেই সাথে এসিডিটি হবার ঝুঁকি কমে যাবে।
৫.অবশ্যই রোজার মাসে এসিডিটি থেকে বাচার জন্য ডিনার কিংবা সেহরি উভয়ক্ষেত্রে শোয়ার ১ ঘন্টা আগে খাবার শেষ করতে হবে এবং খেয়ে অবশ্যই কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে তারপর ঘুমাতে হবে।অন্যথায় এসিডের ব্যাক ফ্লো হয়ে GERD এর মত রোগ হতে পারে।
৬.টক জাতীয় ফলে যদিও প্রচুর পরিমান ভিটামিন সি থাকে তথাপি টক জাতীয় ফলে সাইট্রিক এসিডও থাকে। তাই রোজার সময় টক ফল সাবধানতার সাথে খেতে হবে। ভাল হয় রাতের খাবার শেষ করে খেলে।
৭.টমেটো ইফতারির সময় অনেকের প্রিয় খাবার তবে টমেটোতে প্রচুর পরিমান সাইট্রিক এসিড ও ম্যালিক এসিড থাকে এবং এটা পাকস্থলীতে ইরিটেশন করে তাই টমেটো বেশী পরিমান না খাওয়াই উত্তম।
৮.ঝাল খাবার পাকস্থলীতে এসিডিটির পরিমান বাড়িয়ে দেয় তাই কাচা মরিচ কিংবা অতিরিক্ত ঝাল খাবার পরিহার করে চলতে হবে।
৯.গরম খাবার যথা চা, কফি ইত্যাদি পাকস্থলিতে হাইড্রোক্লোরিক এসিড ক্ষরণের পরিমান বাড়িয়ে দেয় তাই রোজার সময় চা, কফি ইত্যাদি পরিহার করে চলা উচিত।

সেহরির সময় যা করণীয়:
ফজর নামাজের সময় হবার আগ পর্যন্ত সেহরি করা যায়।রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেরিতে সেহরি করার কথা বলেছেন। এটা সুন্নাত, এই সুন্নাত পালনের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা রয়েছে। দেরিতে সেহরি করার জন্য এই কারণে বলা হয়েছে যেনো সেহরি করে ফজর নামাজ এর প্রস্তুতি নেওয়া যায় আর ফজর নামাজ এর প্রস্তুতি নিয়ে নামাজ শেষ করে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে যে ৩০-৪০ মিনিট সময় লাগবে তা খাবার পরিপাকে সহায়তা করে। যদি কেউ ফজরের সময় হবার ১-২ ঘন্টা আগে সেহরি করে তাহলে সে তো আর সেহরি শেষ করে ২ ঘন্টা বসে থাকবেনা বরং শুয়ে পরবে আর খাবার খেয়ে সাথে সাথে শুয়ে যাওয়া এসিডিটির অন্যতম কারণ। তাই দেরিতে সেহরি করা সুন্নাত আর সেহরি করে নামাজ পড়ে তারপর ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্যও উত্তম।

সেহরির খাবারেও এসব জিনিস পরিহার করা উচিত যা পাকস্থলীতে এসিডিটি করে। যেমন চর্বি জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার, চা কফি ইত্যাদি।

পূর্ব থেকেই এসিডিটি কিংবা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা রয়েছে, এমন ক্ষেত্রে করণীয়:

মূলত যাদের এসিডিটির সমস্যা কিংবা গ্যাস্ট্রিক রোগ রয়েছে তারা গ্যাস্ট্রিক এর ঔষধ খেতে পারেন চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে এবং রোযা রাখতে পারবেন আর সাথে সাথে উপরের নিয়মগুলি মেনে চলতে হবে।গ্যাস্ট্রিক এর কয়েক ধরনের ঔষধ রয়েছে তার মধ্যে এন্টাসিড কিংবা ল্যান্সোপ্রাজল ক্যাপসুল খাওয়া যেতে পারে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী । এন্টাসিড প্লাস সিরাপ সন্ধ্যায় খাবারের পরে খাওয়া যায় আর ল্যান্সোপ্রাজল ক্যাপসুল ভোর রাত্রে খেলে উপকার পাওয়া যায়। ল্যান্সোপ্রাজল এর কার্যকারীতা দীর্ঘসময় থাকে।
তথাপি মেডিসিন নেওয়ার পরেও যদি কারো রোজা রাখতে বেশি কষ্ট হয় অথবা যদি প্রচণ্ড বুকে ব্যাথা উঠে তাহলে তার জন্য বিশেষজ্ঞ দীনি ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে রোজা ভংগ করার অবকাশ রয়েছে।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে পবিত্র রমযান মাসের গুরুত্ব বুঝে সিয়াম সাধনা করার তাওফীক দান করুন।

লেখক
ডা.শাইখ ইসমাইল আজহারী
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
মগবাজার, ঢাকা।
ফোন: ০১৬৪০৮০৮৫৪৯
ismailazhari49@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here