নেতিবাচক চিন্তা দূর করার উপায় -দীপন চন্দ্র সরকার

আমাদের মধ্যে একটা প্রবনতা আছে, আমরা যে কোন কিছুর ইতিবাচক দিকের তুলনায়, নেগেটিভ বা নেতিবাচক দিকটাকে বেশি ফোকাস করে থাকি। এর ফলে আমরা কোন কিছুর পজেটিভ দিকটা দেখতে পাই না। আপনি যদি একটু কল্পনা করেন আপনাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, আপনি কি পারেন? বা আপনি মধ্যে কি কি ভালো গুন আছে, এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা সব সময় নিজেকে এমন ভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করি, যেন আমার মধ্যে কোন গুনাবলিই নেই, আমি কিছু পারিই না, আমরা সব সময় নিজেকে ছোট করে উপস্থাপন করতে পছন্দ করি, আমরা ভাবতে থাকি আমি যদি আমার নিজের গুনের কথা নিজে বলি তাহলে অন্যরা আমাকে খারাপ মনে করবে হয়তো তারা আমাকে নিয়ে ভাববে, আমি নিজের ঢোল নিজে পেটাচ্ছি। এভাবে আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যে কি ভাববে বা অন্যে কি মনে করবে এই চিন্তা করে করেই নিজেকে পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এভাবে ধীরে ধীরে নেতিবাচকতার বীজ আমাদের মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং এটা আমাদের মনের মধ্যে নেতিবাচকতার বড় বড় গাছ তৈরি হচ্ছে, আর এর ফলে আমরা নিজেকে যেমন নেগেটিভ ভাবে দেখছি, তেমনি সব কিছুকে নেগেটিভের চশমা দিয়ে দেখা শুরু করেছি। এর পেছনে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও কিছুটা দ্বায়ী কারন আমাদেরকে ছোট বেলা থেকেই এভাবেই গড়ে তোলা হয়, আমাদেরকে সব সময় কথা বলতে নিরুৎসাহিত করা হয়, আমাদেরকে এমন ভাবে শেখানো হয় বড় দের সামনে কথা বলা বেয়াদবী, বড়দের পরামর্শ দেওয়া মানে তাদেরকে অপমান করা, কারও চোখে চোখ রেখে কথা বলা যাবে না। এই নিজেকে ছোট করে দেখার প্রবনতা হয়তো আমাকে কিছু সময়ের জন্য অন্যের কাছে ভালো করছে, বা আদৌ করছে কিনা তাও বা কে বলতে পারে, কিন্তু এটা করে আমরা দিনে দিনে নিজের মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলছি। প্রায়ই দেখা যায় আমরা, আত্মবিশ্বাসের সাথে কারও সাথে কথা বলতে পারি না, আমাদের মধ্যে সামাজিক ভীতি দিন দিন বাসা বাধছে, নিজের আত্মমর্যাদা দীরে ধীরে কমে আসছে, আমরা সাহস করে কারও সাথে কথা বলতে পারি না। আমরা চাইলেই আমাদের মধ্যের এই নেতিবাচক চিন্তা গুলোকে দূর করতে পারি, এর জন্য আমাদের যেটা প্রয়োজন নেগেটিভ চিন্তা গুলোকে দূর করে দিয়ে সেখানে বিকল্প কোন ইতিবাচক চিন্তা প্রবেশ করানো, পাশাপাশি চোখ থেকে নেগেটিভ লেন্স সরিয়ে দিয়ে পজেটিভ লেন্স থেকে দেখার চেষ্টা করা। এর ফলে আপনার মধ্যে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে এবং মানসিক প্রশান্তি ফিরে আসবে। নিচে নেতিবাচক চিন্তা দূর করার জন্য বেশ কিছু টিপস দেওয়া আছে আপনি চাইলে এগুলো আপনার জন্য কাজে লাগাতে পারেন।

টিপস ১ঃ যেকোন নেতিবাচক পরিস্থিতিতে, খুজে বের করুন এখানে ভালো কি ছিলোঃ
যে কোন নেতিবাচক পরিস্থিতিতে আপনি নিজেকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারেন, যেমন, এই পরিস্থিতিতে কোন একটা বিষয় কাজের ছিলো বা ভালো ছিলো? এখানের কোন একটা বিষয়কে আপনি আলাদা ভাবে করতে পারতেন যার ফলাফল বেশ ভালো আসতো? আমি এই পরিস্থিতি থেকে কি শিখলাম? আমার কোন কাছের বন্ধু, এই পরিস্থিতিতে সে কিভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারতো?

টিপস ২ঃ মনে রাখবেন, আপনি কি বলছেন বা করছেন এটা নিয়ে অন্য মানুষের অতটা বেশি মাথা ব্যাথা নেইঃ
আমরা প্রায়ই দেখা যায়, আমরা কোন কিছু করতে গেলে আমরা চিন্তা করতে থাকি এবং সব সময় ভয়ে থাকি, কে কি বলবে, কে কি মনে করবে এটা ভাবতে থাকি। এই পরিস্থিতিতে নিজেকে সব সময় মনে করিয়ে দিন, মানুষের আপনাকে নিয়ে ভাবার অতটা বেশি সময় নেই, কারন সবাই এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, সেও আপনার মত তার নিজেকে নিয়ে চিন্তা করছে, তার ফ্যামিলি, তার ছেলেমেয়ে, তার কাজকর্ম এসব নিয়েই সব সময় ভাবছে, তার কাছে আপনাকে নিয়ে ভাবার মত সময় খুবই কম, এমনকি সেও আপনার মতই ভয়ে থাকছে, তাকে নিয়ে কে কি ভাবছে?

টিপস ৩ঃ চিন্তাগুলোকে প্রশ্ন করুনঃ
যখনই কোন নেতিবাচক চিন্তা আপনার মনে বাসা বাধার চেষ্টা করবে, আপনি চিন্তাটাকে প্রশ্ন করুন, এটা কি সিরিয়াসলি আপনার জন্য ম্যাটার করে কিনা?, আপনি হয়তো অধিকাংশ সময়েই এটার উত্তর পাবেন, আপনি সত্যিকার অর্থেই এটা আপনার জন্য ম্যাটার করে না। কারন, দেখা যায় আপনি হয়তো একটা নেগেটিভ ঘটনা দিয়েই আপনার সারা জীবনকে এটা দিয়ে বিচার করে ফেলছেন, পক্ষান্তরে আপনি যে ৯৯ টা ভালো কাজ করেছেন সেগুলোকে আপনি গুরুত্বই দেননি। অর্থাৎ শুধুমাত্র একটা ভুল কাজ এর মানে এটা নয় যে আমিই সব কাজই ভুল করবো।

টিপস ৪ঃ নেতিবাচকতার উৎস গুলোকে খুজে বের করার চেষ্টা করুনঃ
এখানে আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনার মধ্যকার এই নেতিবাচকতাগুলোর উৎস কি কি? এদের মধ্যে সেরা ৩টি উৎস কি কি? হয়তো দেখা যাবে এই উতসগুলো হচ্ছে, কোন মানুষ, কোন ওয়াবসাইট, কোন নিউজপেপার, অথবা কোন ম্যাগাজিন, অথবা টেলিভিশন। এরপরে নিজেকে প্রশ্ন করুন আমি কিভাবে এই ৩ টি উৎসকে যতটা সম্ভব সবচেয়ে কম সময় দিতে পারি? এরপরে ধীরে ধীরে এগুলো থেকে সময় কমিয়ে নিয়ে এসে অন্য কোন পজেটিভ বিষয়ের প্রতি সময়টা বাড়ানোর চেষ্টা করুন।

টিপস ৫ঃ ছোট মাটির দলা থেকে পাহাড় তৈরি হওয়া বন্ধ করুনঃ
মনের মধ্যে ছোট কোন নেগেটিভ চিন্তা আসলেই এটাকে সাথে সাথে মোকাবিলা করুন, এটাকে শুরুতেই দমন না করতে পারলে, এটা ধীরে ধীরে বৃহৎ আকৃতি ধারন করতে পারে। নিজেকে প্রশ্ন করুন, এটা ৫ বছরে কোন ম্যাটার করে কিনা? এমনকি এটা ৫ সপ্তাহেও ম্যাটার করে কিনা?

টিপস ৬ঃ এটাকে চলে যেতে দিন এবং এটা নিয়ে কথা বলুনঃ
নিজের মনের মধ্যে নেগেটিভ চিন্তাগুলোকে আটকে রাখবেন না, এটাকে এটার মত চলে যেতে দিন। আপনি চাইলে আপনার সমস্যা নিয়ে বা আপনার পরিস্থিতি নিয়ে আপনার খুব কাছের কারো সাথে শেয়ার করতে পারেন। শেয়ার করলে মন হালকা হয়ে যাবে, এবং আপনি এটাকে নতুন ভাবে দেখতে পারবেন, এবং এই সমস্যার জন্য আপনি নতুন করে কর্ম পরিকল্পনা সাজাতে পারবেন।

টিপস ৭ঃ বর্তমানে ফিরে আসুনঃ
নিজের মনকে অতীতের নেগেটিভ চিন্তা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে বর্তমানে ফোকাস করার চেষ্টা করুন। মনোযোগ বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করুন, বর্তমানে এই মুহুর্তে কি কি হচ্ছে সেগুলোকে লক্ষ্য করার চেষ্টা করুন। আপনি এটি আপনার শ্বাস প্রস্বাসের উপরে মনোযোগ দিয়ে বর্তমানে ফিরে আসতে পারেন এর পাশাপাশি আপনার ইন্দ্রীয়গুলোকে ব্যাবহার করে আপনার আশেপাশে চারপাশটাকে ভালো ভাবে লক্ষ্য করতে পারেন। এই অনুশীলনটি ২/৩ মিনিট ধরে করতে পারেন।

টিপস ৮ঃ শারীরিক ব্যায়াম করুনঃ
শারীরিক পরিশ্রম এবং ব্যায়াম মানুষের অভ্যান্তরীন দুশ্চিন্তা, ভয় এবং নেগেটিভ চিন্তাকে দূর করে দেয় এর পাশাপাশি এটি আপনাকে বর্তমানে ফোকাস করতে সাহায্য করবে।

টিপস ৯ঃ অস্পষ্ট ভয় থেকে নিজেকে নিচে টেনে নামাতে দিবেন নাঃ
প্রায়ই দেখা যায় আমরা যখনই কোন কিছুতে ভয় পাই আমরা এটাকে ফেস না করে বরং এই পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এর ফলে ভয় ক্রমেই আমাদেরকে আকড়ে ধরতে থাকে। এই পরিস্থিতি আপনি নিজেকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে পারন, যেমন, এই পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ ক্ষতি কি হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে আপনি হয়তো খুজে পাবেন যে আপনি বিষয়টা নিয়ে যতটা ভয় পাচ্ছিলেন পরিস্থিতি বাস্তবিকই অতটা ভয়ের ছিলো না। শুধু শুধুই আপনি একটা মিথ্যা ভয়ের মধ্যে ছিলেন।

টিপস ১০ঃ অন্য কারো জীবনে ইতিবাচকতা ফিরিয়ে নিয়ে আসুনঃ
আপনি যদি কখনো কোন নেগেটিভ চিন্তার মধ্যে আটকে যান এবং আপনি এই নেগেটিভিটির শিকার হতে থাকেন, এই পরিস্থিতিতে আপনি নিজেকে আপনার চিন্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসুন, এবং মনকে আপনার আশাপাশের অন্য মানুষজনদের প্রতি ফোকাস করুন, আপনি তাদের জীবনে পজেটিভিটি ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে আপনি নিজের মধ্যে ভালোলাগার অনুভুতি লাভ করতে পারেন এবং আপনি আরও অনেক বেশি আশাবাদী হয়ে উঠতে পারেন। এজন্য আপনি কাউকে কোন পজেটিভ কমপ্লিমেন্ট দিতে পারেন, তার ভালো গুনগুলো নিয়ে কথা বলতে পারেন, কাউকে সাহায্য করতে পারেন, এমনকি আপনি কারও সাথে কথা বলে তার সমস্যা নিয়ে কাজ করতে পারেন।

টিপস ১১ঃ আপনার আশেপাশের যে সকল জিনিস আপনাকে নানান ভাবে হেল্প করে থাকে, আপনি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেনঃ
যখন আমরা কোন নেগেটিভিটির মধ্যে থাকি আমরা তখন বেশ সহজেই আমাদের ইতিবাচক বিষয়গুলো ভুলে যেতে থাকি। এমনকি আমাদের জীবনের একটা অংশ যার প্রতি আমরা সব সময় কৃতজ্ঞ থাকি, তাকেও ভুলে যেতে থাকি। এ সময়ে আপনি চাইলে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন। যেমন, আপনি দিনে তিনবেলা খাবার পাচ্ছেন, আপনার মাথার উপরে ছাদ আছে, যা আপনাকে রোদ বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে, আপনি পান করার জন্য পরিষ্কার পানি পাচ্ছেন, আপনি একটা সাপোর্টিভ ফ্যামিলি পেয়েছেন।

টিপস ১২ঃ আপনার আগামী দিনটা এমন ভাবে শুরু করুন যেন আপনার কথায় অন্তত একটা পজেটিভ টোন থাকেঃ
বেশ কিছু সহজ পদ্ধতিতে আপনি আপনার দিনটি একটি পজেটিভ উপায়ে শুরু করতে পারেন, যেমন, আপনি আপনার বেডরুমের দেওয়ালে কিছু ইতিবাচক উক্তি লিখে রাখতে পারেন, বিখ্যাত মনীষীদের বানী লিখে রাখতে পারেন, কিছু মটিভেশনাল বাক্য লিখে রাখতে পারেন, যেন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই এটা আপনার চোখে পড়ে। এবং নিজেকে মনে করিয়ে দিন প্রতিদিন সকাল বেলা এগুলো আপনার একবার পড়তে হবে। আপনি চাইলে আপনার পছন্দের কোন মিউজিক শুনতে পারেন, অথবা আপনার ভালোলাগা কোন লেখা পড়তে পারেন। এর পাশাপাশি আপনি চাইলে আপনার প্রিয় মানুষটির সাথে কিছুক্ষন কথা বলতে পারেন।

টিপস ১৩ঃ প্রয়োজনে সাইকোথেরাপি নিনঃ
আপনি যদি দেখেন আপনার এই নেগেটিভ চিন্তাগুলোর জন্য আপনার জীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রম এ সমস্যা হচ্ছে, আপনার মধ্যে অশান্তি বেড়ে গেছে, আপনি নিজে চেষ্টা করার পরেও নেগেটিভ থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না, এমন পরিস্থিতিতে আপনি চাইলে কোন প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট, অথবা সাইকিয়াট্রিষ্ট এর সাথে যোগাযোগ করে সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং নিতে পারেন। নিয়মিত কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি নিলে এই ধরনের সমস্যা থেকে বেশ সহজেই বের হয়ে আসা সম্ভব।

লেখক:দীপন চন্দ্র সরকার

এসিস্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট
এবং এম ফিল গবেষক
ইমেইল: depondu@gmail.com)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here