ডাক্তারি আলাপ: রুট ক্যানেল- ডা. লিটা বোস

হর হামেশাই দাঁতে তীব্র ব্যথা হলে আমরা ডাক্তারের কাছে যাই বা আমার কাছেই অনেক রোগী আসেন। প্রায়শই যদি বলা হয় রুট ক্যানেল করতে হবে, তখন প্রশ্ন আসে এটা কি? আসুন একটু জেনে নেই আমরা:

রুট ক্যানেল কি?
দাঁত যে মাড়ির সাথে লেগে থাকে, সেটি একটি শিকড়ের সঙ্গে লেগে থাকে। সেই শিকড়ের একটা ক্যানেল থাকে। ওই ক্যানেলের ভিতর পাল্প বা টিস্যু বা দন্তমজ্জা থাকে যে তার প্রদাহ বা সংক্রমন হলে যে চিকিৎসা দেই তাকেই রুট ক্যানেল বলে।

রুট ক্যানেলের প্রয়োজনীয়তা কখন হয়ে থাকে?কখন আমরা বা ডেন্টাল সার্জনরা রুট ক্যানেল করার পরামর্শ দিয়ে থাকি?
সাধারনত শুরুতে দাঁতে ক্যারিজ (দন্ত ক্ষয়) রোগ হয়ে থাকে। অনেকসময় দাঁতের এনামেল এ কাল ও ছোট গর্ত দেখা দিতে পারে, তবে অনেক সময় সাদা সারফেসেও গর্ত হয়ে থাকে- যা “ক্যারিজ প্রব” নানক একধরনের যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এই ডেন্টাল ক্যারিজ শুরুতে দাঁতের উপরি ভাগ অ্যানামেলকে ক্ষয় করে। পরে দাঁতের পরবর্তী লেয়ার ডেন্টিন কে ক্ষয় করে যখন পাল্প বা ডেন্টাল টিস্যু বা দন্ত মজ্জা পর্যন্ত এই ক্ষয় পৌঁছায় তখন দাঁতে প্রচুর ও অসম্ভব ব্যথা অনুভূত হয়। তখন ওই দাঁতকে পুনরায় সংরক্ষণ করার জন্য আমরা রোগীকে রুট ক্যানেল চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে থাকি। এছাড়াও কোন সড়ক বা অন্য কোন দূর্ঘটনায় দাঁতে আঘাত পেয়ে থাকলে দাঁত টাকে পুনরায় সংরক্ষণ করার জন্য আমরা রুট ক্যানেলের পরামর্শ দিয়ে থাকি।

কীভাবে বুঝবো যে এখন রুট ক্যানেল করতে হবে?
সত্যি বলতে সবসময় দাঁতে ব্যথা হলেই যে রুট ক্যানেল করতে হবে ব্যাপারটা তা নয়। অনেক রোগী আসে, এসেই বলে আমার এই দাঁতে রুট ক্যানেল করতে হবে। রুট ক্যানেল করতে হলে আগে অবশ্যই সুনিশ্চিত হতে হবে যে রুট ক্যানেল আসলেই লাগবে কি নাহ। অনেক সময় দাঁতে শুধু শিরশির বা হালকা ব্যথা বা স্পর্শকাতরতা থাকতে পারে সেক্ষেত্রে রুট ক্যানেল করার পরামর্শ দেয়া হয় না। রুট ক্যানেল করার জন্য ক্যারিজ বা ক্ষয় অথবা যে কোন আঘাত দাঁতের নার্ভ টিস্যু বা মজ্জা পর্যন্ত চলে যেতে হবে। এক্ষত্রে সাধারণত রাতের বেলা রোগীর দাঁতে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হবে। তখন আমরা রোগীকে অবশ্যই রুট ক্যানেল করতে বলবো। তবে যে গুলো দীর্ঘমেয়াদী (ক্রনিক) বা ক্রমাগত ভাবে হালকা হালকা ব্যথা হয়েছে, যার ফলে রোগী নিজেই আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ফার্মেসী থেকে ব্যথা নাশক ঔষধ নিয়ে ব্যথা কমিয়ে রেখেছেন দীর্ঘদিন এবং দাঁতের গর্ত টা বড় হয়েছে সেক্ষেত্রে প্রচুর ব্যথা না থাকলেও রুট ক্যানেল করা লাগতে পারে।

রুট ক্যানেল করার আগে কোন পরীক্ষা করা লাগবে কিনা?
হ্যা অবশ্যই লাগবে। কিছু পরীক্ষা আছে যা ডাক্তার নিজেই চেম্বারে চেয়ার সিটিং কিছু ইন্সট্রুমেন্ট এর মাধ্যমে করতে পারেন। তবে রোগী ও ডাক্তার দুজনের জন্যই নিশ্চিত রুট ক্যানেলের জন্য এক্সরে করা টাই উত্তম।এক্ষেত্রে বড় এক্সরে বা ওপিজি (OPG), ছোট এক্সরে বা পেরিএপিকাল (Peri apical)এক্সরে করা হয়। দাঁতের সংক্রমণ ও পজিশন এর উপর নির্ভর করে কখনো একটা বা দুটো এক্সরে করা লাগতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এক্ষেত্রে এক্সরে করা উচিত।

একটা সাধারণ প্রশ্ন থাকে রোগীর- “রুট ক্যানেল করতে ব্যথা পাবো কি”?
রুট ক্যানেল করাই হয় রোগীর ব্যথা কমানোর জন্য। আসলে রোগী দাঁতে সংক্রমণের জন্য এতোই ব্যথা অনুভূত করেন যে রুট ক্যানেলে দাঁতের ভিতরে কাজ হবে এটা ভেবেই তিনি আরো ভয় পেয়ে যান। এখন আমাদের ডেন্টাল পেশা অনেক উন্নত হয়েছে এবং অ্যানেস্থেশিয়াও রয়েছে যেগুলো আমরা রুট ক্যানেল করার আগে দিয়ে দেই। ব্যথামুক্ত করে রুট ক্যানেল করা আরম্ভ করি। আর এই অ্যানেস্থেশিয়া আপনার জ্ঞান বা চেতনা রেখেই ব্যথামুক্ত ভাবে দাঁতের চিকিৎসা করতে সাহায্য করে।

সময়!! কত সময় বা কত দিন লাগবে রুট ক্যানেল চিকিৎসা সম্পূর্ণ করতে?
বর্তমানে আমাদের ডেন্টাল চিকিৎসার আধুনিকতায় ও ভালো ম্যাটেরিয়াল, ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবহারের ফলশ্রুতিতে ১দিনে বা ১ সিটিংয়েই রুট ক্যানেল করা সম্ভব, তবে এটা ক্ষেত্র বিশেষে করা হয়ে থাকে। রোগী ও ডাক্তারের উপর সময়সহ দাঁতের অবস্থার উপর নির্ভর করবে। এছাড়া আমরা রোগীকে ০৩ সিটিংয়ে ৫-৭ দিন সময়ের কথা বলে থাকি।

রোগীর প্রশ্ন থাকে, কীভাবে করবেন এই রুট ক্যানেল? পরবর্তী তে কী করনীয়?
আমাদের প্রধান কাজ হলো দাঁতের শিকড়ের ভিতর সংক্রমন বা প্রদাহ দূর করা। অ্যানেস্থেসিয়ার মাধ্যমে ব্যথা মুক্ত করে দাঁতের ভিতরের সংক্রমিত মজ্জা বা পাল্পটিস্যু গুলো বের করে দেই এবং এর ভিতরে নার্ভ এর সাবস্টিটিউট বা এর মতো এক ধরনের ম্যাটেরিয়াল ঢুকিয়ে সিল করে দেই যা দাঁতের শিকড়ের ভিতরের অবস্থার সাথে মানানসই। দাঁতটা তখন জড় পদার্থের মতো তার জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। এজন্য পরবর্তীতে আমরা রোগীকে পরামর্শ দেই ক্রাউন বা ক্যাপ করে নেবার জন্য। যা দাঁতের উপরে কিছুটা দাঁতের উপরের অংশের আদলে টুপির মতো করে তৈরী করা হয়।স্থির হওয়া দাঁতকে সুরক্ষিত রাখে।

কি করলে বা কীভাবে দাঁতের যত্ন নিলে এই রুট ক্যানেল চিকিৎসা করা থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন?
আমরা সবাই একটা কথা জানি যে “প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধ উত্তম”। প্রথমত আমাদের মুখগহ্বরের ভিতরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা যদি ২৪ ঘন্টায় দুবার দাঁত ব্রাশ করে থাকি এবং দিনে একবার ফ্লসিং করি তাহলে দাঁত ভালো থাকবে। আমরা সাধারণত ফ্লসিং করি নাহ আর সঠিক নিয়ম মেনে দাঁতও ব্রাশ করি নাহ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমরা যে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী দাঁত ব্রাশ করি তা কিন্ত ঠিক নয়। আসলে সকালে খাবার পর ও রাতে খাবারের পর দাঁত ব্রাশ করতে হবে। রাতে দাঁত ব্রাশ করার পর পানি ছাড়া অন্য কোন পানীয়,শর্করা বা মিস্টি জাতীয় যে কোন কিছুই খাওয়া থেকে বিরত থাকবো। এছাড়াও বছরে প্রতি ৬মাস অন্তর, ২বার যদি নিয়মিত চেক-আপ অনুযায়ী ডেন্টাল সার্জন এর কাছে যাওয়া হয় তাহলে সমস্যা গুরুতর হওয়ার আগেই চিকিৎসা নিতে পারবো। আমরা দাঁত সুস্থ রেখে ভালো থাকতে পারবো। তাহলেই দাঁত থাকতে দাঁতের সঠিক মর্যাদা দেয়া হবে।

ডা.লিটা বোস
বিডিএস, ডেন্টাল সার্জন
বি.এম.ডি.সি রেজি নংঃ ৭৩৫৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here