একজন করোনাযোদ্ধার উপলব্ধিঃ ভালবাসার কাছে যেখানে কভিড-১৯ পরাজিত

আমার পরিচয় দিয়ে শুরু করি। আমি একজন নার্স। করোনা ওয়ার্ড শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। জীবনের স্বল্প অভিজ্ঞতা ও কাজের মধ্যে এই করোনা রোগীদের সেবা দিতে পারাটাই ছিলো আমার জন্য এক অন্যরকম ভালোলাগা ও নতুন অভিজ্ঞতা।
এটি এমন একটি রোগ যেখানে আপনজন ও আপনার কাছে যেতে চাইবেন না।এখানেই খুঁজে পাবেন কে সত্যিকারের আপনার প্রিয়জন।কভিড-১৯ শিক্ষা দিয়েছে এমন খুজে বের করার প্রক্রিয়া। প্রতিদিনই আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরা কমবেশি ভালো-খারাপ কিছুনা কিছু ঘটনার সাক্ষী হই। কাজের সুবাধে দেখেছি কভিড-১৯ ভালবাসার কাছে হেরে যেতে।কভিড-১৯ কে হেরে যেতে দেখেছি ছেলে ও মায়ের ভালোবাসার কাছে।
আমরা সচারাচর শুনে থাকি ও দেখি মা-বাবার জন্য সাধারণত মেয়েরাই বেশি যত্নশীল। কিন্তু একজন ছেলেও যে তার মায়ের জন্য অনেক যত্নশীল তা মোঃ শিহাব উদ্দিনকে না দেখলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না।মোঃ শিহাব উদ্দিন জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে কর্মরত একজন কর্মকর্তা।
রাবেয়া খাতুন (৭৮) শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের ভর্তি আছেন। তিনি বর্তমানে করোনা পজিটিভ সাথে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস সহ জটিল রোগে আক্রান্ত।
গত ১৭ই আগস্ট বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে রাত ২টার দিকে তাকে হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি করেন তার ছেলে মোঃ শিহাব উদ্দিন।তখন তার অক্সিজেন সেচুরেশন ছিলো মাত্র ৪৮।আমাদের কাছে ক্রিটিকাল পেশেন্ট। কান্না করার মতো। কিন্তু কান্নাকে হাসিতে পরিনত করতে কি শ্রম দিতে হয় সেটা জানতেন ছেলে। সেদিন রাতে ছেলের বুক ফাটা চাপা কান্না আজ ও আমার চোখে পানি এনে দেয়। মায়ের জন্য কতইনা কষ্ট পাচ্ছিলেন সেদিন। কান্না কষ্ট আর কারো ঘাড়ে অপবাদ চাপিয়ে তার দায়িত্ব শেষ করেন নাই।পরিশ্রম করেছেন দিনরাত। আমাদের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি মানুষিক ও শারিরিক সেবা চালিয়ে গেছেন অক্লান্ত।

আল্লাহর অশেষ রহমতে মা আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ। যদিও ২৪ ঘন্টা অক্সিজেন সাপোর্টেই তার সময় কাটছে। সারাক্ষণ মায়ের পরম সেবায় নিয়োজিত ছেলে শিহাব উদ্দিন। কখনো হাত পা ম্যাসেজ করে দেয়া,মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া,অক্সিজেন সেচুরেশন চেক করা, মাথায় চিরুনী দেয়া,ডায়াবেটিস চেক করা,খাবার দেয়া,সময়মত ঔষধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে সবকিছু।
মা যখন নিজে নিজে বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন তখন তার প্রসাব পায়খানা পরিস্কার থেকে শুরু করে সবকিছুতেই যেন এক আলাদা শান্তি অনুভব করছেন ছেলে।সারারাত যখন মায়ের পাশে বসে থাকেন মনে হয় যেন মায়ের প্রতিটি হৃদ স্পন্দন তিনি হিসেব করে রাখছেন।জিজ্ঞেস করলাম অন্তত বিশ্রাম তো নিতে হবে তাকে।কেন নিতে যাচ্ছেন না? যদি মায়ের কষ্ট হয় সেই ভাবনা থেকেই তিনি মায়ের কাছে সবসময় তার অবস্থান করা। আলহামদুলিল্লাহ তিনি তার আন্তরিকতায় সাফল্য পেয়েছেন। কভিড-১৯ জয় করেছেন ভালবাসা দিয়ে।
আমরা অল্পতে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে অভ্যস্ত! কিছু হলেই ডাক্তার বা নার্সের উপর ক্ষেপে যাওয়া আমাদের স্বভাব। আমাদের নিজেদের রোগীর জন্য আমরা কখনো আন্তরিকতা দেখাই এরকম উদাহারন খুব কম। অস্থিরতা ও ঝামেলা সৃষ্টিতে আমরা পটু। এই সময়ে আতংকের নাম কভিড-১৯। এই আতংককে উপেক্ষা করে সেবার যে নজির সৃষ্টি করেছেন শিহাব উদ্দিন তা সমাজের জন্য একটা রোল মডেল।
অর্থ,প্রাচুর্য,খ্যাতি সবকিছুই ছিলো। চাইলে তারাও পারতেন কিছু ধনীদের ন্যায় দুজন লোক রেখে মায়ের জন্য সেবা নিতে। কিন্তু তারা তা করেননি কারণ মায়ের প্রতি আছে ভালোবাসা ও অর্পিত দায়িত্ব। আর সেই দায়িত্ববোধ থেকেই তার মায়ের সেবা করার মাধ্যমে সৃস্টিকর্তাকে খুশি করেছেন।
হাসপাতালের তার আই আন্তরিকতা ও সহযোগীতার এই দৃশ্য প্রতিদিন আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে উজ্জীবিত করে তোলে। বিশেষ করে প্রতিদিন যখন রাবেয়া খাতুন এর কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে জানতে চাই নানু কেমন আছেন? তার উত্তরে যখন সে হাসি মুখে বলেন আলহামদুলিল্লাহ! ভালো আছি নানু। তখন একজন নার্স হিসেবে নিজেকে অনেক গর্বিত অনুভব করি। আর মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত সুখ মনে হয় এই মহান সেবামূলক পেশায়।

খুব দ্রুত রাবেয়া খাতুন সুস্থ হয়ে তার আপনজনকে সঙ্গে নিয়ে আপন নীড়ে ফিরবে এই দোয়া করি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে। আর যেন সকল মা বাবা যেন মোঃ শিহাব উদ্দিনের মতো ছেলেমেয়ের ভালবাসায় আজীবন বেচে থাকে সেই প্রার্থনা করি মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট।

মোঃ মাহমুদুল হাসান (সম্রাট)
নার্সিং অফিসার
সেবাচিমহা,বরিশাল।
sm.samrat19@yahoo.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here