চেক ডিজঅনারের আইনগত প্রতিকার

বর্তমানে বাংলাদেশের আদালত গুলোতে বিচারধীন মামলাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা হলো চেক ডিজঅনারের মামলা। তাই এ বিষয় নিয়ে আলোচনার আগে চেক নিয়ে আলোচনা করা দরকার।
চেক
অতি প্রাচীন কাল থেকে ব্যাংক ব্যবস্থায় চেকের ব্যবহার হয়ে আসছে। চেক(Cheque), এমন একটি হস্তান্তরযোগ্য দলিল যার মাধ্যমে ব্যাংকের আমানতকারি লিখিত ও শর্তহীনভাবে ব্যাংক কে চেকের বাহককে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করে থাকে। যিনি চেক লেখেন তিনি আদেষ্টা বা ড্রয়ার হিসাবে পরিচিত। আদেষ্টা বা ড্রয়ার চেকে মুদ্রার পরিমাণ, তারিখ এবং চেকের প্রাপক সহ বিভিন্ন বিবরণ লিখে তাতে স্বাক্ষর করে ব্যাংকে আদেশ দেয়, এক্ষেত্রে ব্যাংক কে আদিষ্ট বা ড্রয়ী বলা হয়। ব্যাংক আদেশ দেয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিবৃত অর্থ পরিশোধ করে। আদেষ্টার অবশ্যই আদিষ্ট ব্যাংকে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে।
বাংলাদেশে বলবৎ ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, (A “Cheque” is a bill of exchange drawn on a specified banker and not expressed to be payable otherwise than on demand.) অর্থাৎ চেক হল এক ধরনের বিনিময় বিল যা কোন নির্দিষ্ট ব্যাংকের উপর কাটা হয় এবং যার অর্থ চাহিবামাত্র পরিশোধ্য। অর্থাৎ চেক হলো এমন একটি হস্তান্তরযোগ্য দলিল যা প্রস্তুতকারক কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মাধ্যমে আমাতকারী ব্যাংকে রক্ষিত তার আমানত থেকে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে অথবা তার আদেশে কোন ব্যক্তিকে বা বাহককে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রদানের জন্য ব্যাংকের প্রতি শর্তহীন লিখিত আদেশ প্রদান করে; যার অর্থ চাহিবা মাত্র পরিশোধ্য।
চেক এর বৈশিষ্ট্য:
চেক বা Cheque হলো বিশেষভাবে মুদ্রিত এক ধরনের কাগজ যা ব্যাংক কর্তৃক গ্রাহকের হিসাবের বিপরীতে ইস্যু করা হয়ে থাকে। চেকের বিশেষ কতকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
চেকের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি নিন্মরুপঃ
• লিখিতঃ
একটি চেক অবশ্যই লিখিত হতে হবে। কোন ফাঁকা চেক অর্থ পরিশোধের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয় না। একটি চেকে অবশ্যই আমানতকারির স্বাক্ষর, তারিখ, নির্দিষ্ট প্রাপক এবং টাকার পরিমাণ কথায় ও অংকে লেখা থাকতে হবে। অন্যথায় ব্যাংক অর্থ পরিশোধে বাধ্য নয়।
• শর্তহীনঃ
একটি চেক সর্বদাই একটি শর্তহীন আদেশ বহন করে। শর্তারোপ করলে কোন চেক অর্থ পরিশোধের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয় না।
• ব্যাংকের উপর আদেশঃ
চেকের মাধ্যমে সর্বদা একটি ব্যাংককে আদেশ দেয়া হয়। ব্যাংক ছাড়া অন্য কারো উপর চেকের মাধ্যমে আদেশ দেয়া যায় না।
• চাহিবামাত্র পরিশোধযোগ্যঃ
চেক চাহিবামাত্র পরিশোধযোগ্য একটি হস্তান্তরযোগ্য দলিল। তাই ব্যাংকে উপস্থাপনের সাথে সাথে ব্যাংক চেকের টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য।
চেকের পক্ষসমূহ:
একটি চেকের সাধারণত তিনটি পক্ষ থাকে। পক্ষ তিনটি হচ্ছে-
-আদেষ্টা (ড্রয়ার)
-আদিষ্ট বা ব্যাংক (ড্রয়ী), এবং
-প্রাপক (পেয়ী)
চেকের প্রকারভেদ
নিম্নে কয়েক প্রকার চেকের উল্লেখ করা হলঃ
-বাহক চেকঃ
যখন চেকে “অথবা বাহককে (or Bearer)” লেখা থাকে তাকে বাহক চেক বলে। বাহক চেক যে কোন ব্যক্তি ব্যাংকে উপস্থাপন করলেই ব্যাংক তাকে টাকা দিতে বাধ্য থাকে। তাই এ ধরনের চেকে ঝুঁকি বেশী।
-হুকুম চেকঃ
যখন চেক “অথবা বাহককে (or Bearer)” কেটে দেয়া হয় এবং কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা হয় তখন তাকে হুকুম চেক বলে। এ ধরনের চেকের অর্থ শুধু মাত্র চেকে যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা আছে তাকেই অর্থ পরিশোধ করা হয়।
-দাগকাটা চেকঃ
যখন চেকের উপর দুটি সমান্তরার দাগ দেয়া হয় এবং “& CO.” or “Account Payee” or “Not Negotiable” লেখা থাকে তখন তাকে দাগকাটা চেক বলে।
দাগ কাটা চেক আবার দুই ধরনের হয়, যথা-
o সাধারণ দাগকাটা চেক ও
o বিশেষভাবে দাগকাটা চেক-যখন সমান্তরাল দুটি রেখার ভিতরে কোন ব্যাংকের নাম লেখা থাকে তখন তাকে বিশেষভাবে দাগকাটা চেক বলে।
-এন্টি ডেটেড চেকঃ
চেক যেদিন ব্যাংকে উপস্থাপন করা হয় এবং তারিখ যদি তার পূর্বের হয় তখন তাকে এন্টি ডেট চেক বলে।
-পোস্ট ডেটেড চেকঃ
চেকে ভবিষ্যতের তারিখ থাকলে তখন তাকে পোস্ট ডেটেড চেক বলে। ব্যাংক এ ধরনের চেকের বিপরীতে তারিখ না আসা পর্যন্ত অর্থ পরিশোধ করে না।
-স্টেল বা বাসি চেকঃ
কোন চেক যখন উল্লেখিত তারিখের ৬ বা ১৮০ দিন পরে ব্যাংকে উপস্থাপন করা হয় তখন তাকে স্টেল চেক বলে। এ ধরনের চেকের বিপরীতে ব্যাংক কখনো টাকা দেয় না।
চেক ডিজঅনার
অপর্যাপ্ত তহবিল, ত্রুটিপূর্ণ স্বাক্ষর ও অন্য যে কোন যথাযথ কারনে বাহক কতৃক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা দেয়া চেক যদি প্রত্যাখ্যাত হয় বা চেকে উল্লেখিত টাকা বাহককে প্রদান করা সম্ভব না হয় সেটিকেই বলা হয় চেক ডিজঅনার। কোনো ব্যক্তি যে ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট রয়েছে সেই অ্যাকাউন্ট হতে অন্য কোনো ব্যক্তিকে টাকা প্রদানের জন্য চেক ইস্যু করেন এবং উক্ত অ্যাকাউন্টে যদি চেকে বর্ণিত টাকার অঙ্কের চেয়ে কম টাকা থাকে এবং চেকটি যদি ব্যাংক অপরিশোধিত অবস্থায় ফেরত দেয় তাহলে চেকদাতা একটি অপরাধ সংঘটিত করেছে বলে গণ্য হবে। তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে ব্যাংকের চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
যে সব কারণে চেক ডিজঅনার হতে পারে:
১। চেক মেয়াদোত্তীর্ণ হলে।
২। যথাযথভাবে চেক পূরণ করা না হলে।
৩। চেকে ড্রয়ারে স্বাক্ষর না হলে।
৪। চেক পোস্ট ডেটেড অর্থাৎ পর-তারিখের হলে।
৫। চেকে স্বাক্ষরের সঙ্গে ব্যাংকে রক্ষিত গ্রাহকের নমুনা স্বাক্ষরের অমিল হলে।
৬। চেকে উল্লিখিত টাকার পরিমাণ অঙ্কে ও কথায় অমিল হলে।
৭।হিসাবে পর্যাপ্ত taka না থাকলে।
৮। চেকে ঘষামাজা থাকলে।
৯।চেকে কাটাকাটি থাকলে পূর্ণ স্বাক্ষর দিয়ে তা সত্যকরণ না করা হলে।
১০। ব্যাংকিং সময়ের পর চেক উপস্থাপন করা হলে।
এ ছাড়া আরো অনেক কারণে চেক প্রত্যাখ্যাত (বাউন্স) হতে পারে। যে কারণে চেকটি প্রত্যাখ্যাত হলো তা চিহ্নিত করে ওই স্লিপসহ চেকটি প্রাপকের কাছে ব্যাংক ফেরত পাঠায়।
চেক ডিজঅনার হলে কি করবেন?
নেগোসিয়েবল ইনসট্রুমেন্ট অ্যাক্টের (এনআই অ্যাক্ট) ১৩৮, ১৪০ ও ১৪১ ধারায় তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে ব্যাংকের চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অপরাধের জন্য আইনি প্রতিকারের বিধান রাখা হয়েছে।cheque/চেক ডিজাইনার হলে এন আই অ্যাক্টের বিধান মতে, চেক ৬ মাসের মধ্যে যেদিন ডিজঅনার হয় সে দিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে লিগ্যাল নোটিশ প্রদানের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
কোন চেক ডিজঅনার হলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নিতে হবে:
১। চেকটি প্রস্তুত হওয়ার তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে ব্যাংকে উপস্থাপন করতে হবে।
২। চেকটি ব্যাংক কর্তৃক চেকটি ফেরত কিংবা ডিসঅনার হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেকে বর্ণিত টাকা পরিশোধের দাবি জানিয়ে চেক প্রদানকারীকে লিখিত নোটিশ প্রদান করবেন।
৩।উক্ত নোটিশপ্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেক প্রদানকারী চেকের প্রাপককে অথবা যথানিয়মে ধারকের বরাবর উল্লিখিত অঙ্কের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে মামলার কারণ উদ্ভব হবে।
৪। মামলার কারণ উদ্ভব হওয়ার তারিখ হতে ৩০ দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।
কোথায় মামলা করবেন:
হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনে সাধারণত চেকডিসঅনারের অভিযোগ ১৩৮ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। এই ধরনের মামলা নালিশী মামলা হিসেবে গণ্য হয়। তার মানে চেকডিসঅনারের মামলা কখনো থানায় করা যায় না। এই ধরণের মামলা নালিশের মাধ্যমে যে আদালতের স্থানীয় এক্তিয়ারের মধ্যে নালিশের কারণ উদ্ভব হয়েছে সবসময় সেই আমলী আদালতে দায়ের করতে হয়। নালিশী মামলা বলতে বোঝায়, যে সকল মামলা থানায় এফ.আই.আর এর মাধ্যমে ফাইল না করে সরাসরি অভিযোগ দায়েরের মাধ্যমে আদালতে দাখিল করা হয় তাকে নালিশী মামলা বলে। নালিশী মামলায় ফরিয়াদীকে মামলার খরচ বহন করতে হবে। ফরিয়াদী মানে হল মামলার অভিযোগকারী ব্যক্তি।
চেক ডিসঅনারের মামলা যে আদালতে বিচার্য:
দায়রা আদালতে চেক ডিসঅনারের মামলার বিচার হয়ে থাকে।
দায়রা আদালত নিম্নলিখিত জজদের অন্তর্ভূক্ত করবে। যথা:
• দায়রা জজ।
• অতিরিক্ত দায়রা জজ।
• যুগ্ম দায়রা জজ।
চেক ডিসঅনার অপরাধের শাস্তি:
এক বছর মেয়াদ পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত অথবা চেকে বর্ণিত অর্থের তিনগুণ অর্থদণ্ড অথবা উভয় দন্ডে দণ্ডিত হবে। আদালত অপরাধ প্রমাণ সাপেক্ষে নিজ বিবেচনা মোতাবেক হয়ত শুধুমাত্র কারাদণ্ডের শাস্তি অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড প্রদান করতে পারেন। হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮(১) ধারায় চেক প্রত্যাখ্যাত হবার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এখানে বলা আছে চেক ডিসঅনারের শাস্তি হল ১ বছরের কারাদন্ড অথবা চেকে উল্লেখিত টাকার ৩ গুন জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড।
আপিল দায়ের:
তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে ব্যাংক চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অপরাধে আদালত কাউকে কারাদণ্ড প্রদান করলে তার বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে, প্রত্যাখ্যাত চেকের মূল্যের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ অর্থ সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিয়ে আপিল করতে হয়।হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনে আপীল সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এক্ষেত্রে CrPC এর আপীলের বিধান কার্যকর হবে। চেক ডিসঅনারের মামলাটি যদি যুগ্ম দায়রা জজ কর্তৃক বিচার হয় তাহলে দায়রা জজের নিকট ৩০ দিনের মধ্যে আপীল করতে হবে। এক্ষেত্রে CrPC এর ৪০৮ ধারার আপীলের বিধানটি প্রযোজ্য হবে। এখানে বলা হয়েছে, যুগ্ম দায়রা জজের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজের নিকট আপীল করা যাবে।অন্যদিকে চেক ডিসঅনারের মামলাটি যদি দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজ কর্তৃক বিচার করা হয়, তাহলে ৬০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করা যাবে। এক্ষেত্রে CrPC এর ৪১০ ধারার আপীলের বিধানটি প্রযোজ্য হবে। এখানে বলা হয়েছে, দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজের দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করা যাবে।
যেহেতু চেকে উল্লেখিত পরিমান টাকা একাউন্ট হোল্ডার দিতে বাধ্য,তাই কাউকে চেক প্রদান করার পুর্বে অঙ্কে এবং কথায় টাকার পরিমান এমন স্পষ্ট ভাবে লেখা দরকার যাতে কেউ সেটা আর পরে বাডিয়ে লিখে নিতে না পারে।
আরশাদ নাজীব
এডভোকেট
জজ কোর্ট টাংগাইল
E-mail:nazibadv@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here