সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য

ইরফানা সামিয়াঃ আজ আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২০ । এবারের বিষয় “সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য, বৃহত্তর বিনিয়োগ, বৃহত্তর প্রবেশাধিকার” এবং এর যথার্থতা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই । কারন আমার কাছে এবারের বিষয়ের প্রত্যেকটি শব্দ খুবই জোরালো এবং যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে। আর মানসিক স্বাস্থ্যকে এত দৃঢ়ভাবে উপস্থাপনের পিছনে যে বিষয়টি এবার কাজ করেছে তা হচ্ছে কোভিড-১৯ পেনডেমিক পরিস্থিতি। কারন এর ফলে গোটা বিশ্ব ভীষণ এক প্রতিকূলতা মোকাবেলা করছে এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমূল এক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যা এর আগে কেউ কখনও দেখেনি। করোনা ভাইরাস যতটা না শারীরিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরী করেছে, তার চেয়ে বহুগুন বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলেছে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে। আর এই বিষয়টা অনুধাবন করেছেন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী থেকে শুরু করে সাধারন মানুষ।

কোভিড-১৯ এর জন্য প্রস্তুত ছিল না বিশ্ব এবং এর মানবকূল। কোন বিষয়ের জন্য যখন আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকি , তখন তা মোকাবেলা করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতির প্রাদুর্ভাবে বিশ্বজুড়ে বেশীরভাগ মানুষই এক ধরনের উদ্বিগ্নতা, ভয়, অনিশ্চয়তা, অসহায়ত্ব, অস্বস্তি, একাকীত্ব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ অনুভব করেছে এবং এখনও করছে। এই পরিস্থিতি কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যের তিনটি উপকরণকেই ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বাস্থ্য হচ্ছে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুঅবস্থা। কারণ, করোনা ভাইরাস যেহেতু মানুষের শরীরে সংক্রামক ব্যাধি তৈরী করছে, তাই এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রন করতে সামাজিক দূরত্বের উপর জোর দেয়া হয়েছে। শরীরে রোগের প্রাদুর্ভাব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা , এই দুটি বিষয় আবার প্রভাবিত করছে আমাদের মানসিক অবস্থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা , বৈশ্বিক স্বাস্থ্য জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছে। বিশ্বজুড়ে একসাথে একই কারনে এত মানুষের মৃত্যু আগে কখনও লক্ষ করা যায়নি। তাই অন্যান্য নেতিবাচক অনুভূতির পাশাপাশি সবচেয়ে বেশী যে অনুভূতিটি মানুষের মনে কাজ করেছে তা হচ্ছে দুঃখবোধ এবং শোক। কাছের দূরের অনেক চেনা এবং প্রিয় মুখ চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এত মৃত্যু আর বিছিন্নতা আমাদের মনে তৈরী করছে এক সমষ্টিগত শোকের। তাই কোভিড এর ফলে সৃষ্ট সকল ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতি এবং শোকানুভূতি কাটিয়ে উঠতে বিশ্বজুড়ে মনোবৈজ্ঞানিক সহায়তা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবার প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এ পরিস্থিতির ভয়াবহতার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে প্রত্যেকটি মানুষকে তার মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা নিতে হবে। আর এ লক্ষ্যেই এবারের বিষয়ে যুক্ত করা হয়েছে “সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য” কথাটি।

এবার যদি একটু মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের বিষয়টির শেষ অংশকে সামনে নিয়ে আসি- “বৃহত্তর বিনিয়োগ, বৃহত্তর প্রবেশাধিকার” অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সর্বসাধারনের হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিতে বৃহত্তর বিনিয়োগ। তবে অত্যন্ত মর্মাহত হৃদয়ে বলতে হয়, বাস্তবতা খুবই ভিন্ন। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশের সাধারন জনগনের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা যেমন খুব বেশী তৈরী হয় নি এবং এক্ষেত্রে উদ্যোগ, বিনিয়োগ বা প্রবেশাধিকার যাই বলা হোক না কেন – এখনও সর্বসাধারনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয় নি। আর এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতির ফলে উদ্ভূত মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি সামাল দিতে বিশ্বের অনেক দেশই এখন হিমশিম খাচ্ছে।

বৃহত্তর বিনিয়োগ বলতে অনেকেই মনে করতে পারেন রাষ্ট্রপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ, যাতে করে মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজেই পেতে পারে। এর পাশাপাশি এই বিনিয়োগ ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহন করা এবং এর যত্ন নেয়ার জন্য ব্যক্তির যে প্রচেষ্টা বা উদ্যোগের বিনিয়োগ তা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিপর্যায়ে এবং পরিবারে এখন থেকেই শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের বিষয়টি সামনে আনতে হবে এবং জানতে হবে মানসিক স্বাস্থ্য কি , কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ এবং কিভাবে এর যত্ন নিতে হয়।

একটু যদি আলোকপাত করি, মানসিক স্বাস্থ্য বলতে কি বোঝায়? খুব সহজভাবে বলতে গেলে আমরা কিভাবে চিন্তা, অনুভব এবং আচরন করব তা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে নির্ভরশীল। আরেকভাবে বলতে গেলে, মানসিক স্বাস্থ্য হচ্ছে আবেগীয় এবং আধ্যাত্নিক স্থিতাবস্থা যার সাহায্যে দুঃখ, কষ্ট, হতাশাকে কাটিয়ে আমরা জীবনকে উপভোগ করতে পারি। মানসিক স্বাস্থ্য বলতে আরও বোঝায় আমাদের নিজেদের জীবনকে এগিয়ে নেয়ার ইতিবাচক ইচ্ছা শক্তি বা প্রেরনা, নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং নিজের ও অন্যের প্রতি সম্মান ও মর্যাদাবোধের প্রকাশ। এই শেষের লাইনটিতে একটু আলোকপাত না করলেই নয়। কারন বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি যেখানে ব্যক্তি নিজেকে এবং তার আশেপাশের মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে বা মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলে ঘটে যাচ্ছে নেতিবাচক অনেক ঘটনা। দেখা যাচ্ছে নৈতিকতার চরম অবক্ষয়। একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য যখন নিশ্চিত হবে তখন এই নৈতিকতার অবক্ষয় কমবে।

ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য আর ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্রকে একসাথে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে পরিবার এবং রাষ্ট্র। পরিবারে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের গঠনে বাবা মাকে উদ্যোগী হতে হবে। শারীরিক সুস্বাস্থ্যের জন্য যেমন সুষম খাবার প্রয়োজন তেমনি মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন সুন্দর আর সুস্থ পরিবেশ। তাহলেই নিশ্চিত হবে সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য।

শরীরে যেমন শারীরিক সমস্যা হতে পারে, ঠিক তেমনি মনেরও সমস্যা হতে পারে এবং এই সমস্যা দূর করতে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর (প্রশিক্ষিত মনোবিজ্ঞানী/কাউন্সেলর/ সাইকোথেরাপিস্ট/মনঃচিকিৎসক) সহায়তা নেয়া যেতে পারে, ঠিক যেমনটি আমরা শারীরিক রোগের জন্য ডাক্তারের কাছে যাই। আর আমরা যেমন শারীরিক অবস্থা জানতে বিভিন্ন পরীক্ষা করে থাকি ঠিক তেমনি আমাদের এবং পরিবারের সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যটি অটুট আছে কিনা তা নিয়ে কিন্তু মনোযোগী হতে হবে।

কোন একটি পরিস্থিতিতে আমাদের ভাবনাগুলো, অনুভূতিগুলো যদি কারও কাছে তুলে ধরা যায় বা প্রকাশ করা যায় এবং কেউ যদি তা মনোযোগ দিয়ে এবং নিরপেক্ষভাবে শোনে তাহলে কিন্তু আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যটিকে আমরা চাঙ্গা রাখতে পারি। তাই পরিবারে এবং সর্বত্র মানসিক স্বাস্থ্য এবং এর যত্নের কথা শুরু হোক, শুরু হোক আমাদের ভাবনা আর অনুভূতির প্রকাশের চর্চা, তাহলেই আমরা বৃহত্তর বিনিয়োগের আর বৃহত্তর প্রবেশাধিকারের দিকে এগিয়ে যাব, নিশ্চিত হবে সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য।

ইরফানা সামিয়া
শিক্ষা ও শিশু মনোবিজ্ঞানী,
সাইকোথেরাপিস্ট ও কাউন্সেলর
ন্যশনাল ইন্সট্রাক্টর -ইয়ুথ মেন্টাল হেল্‌থ ফার্স্ট এইড

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here