হাত বা পায়ে হঠাৎ তীব্র ব্যথা, আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে অবশ হয়ে যাচ্ছে- কী করবেন?

রহিমা বেগম, বয়স ৩৫ বৎসর পেশায় গার্মেন্টস কর্মী। একদিন হঠাৎ তার বাম হাতে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলেন। হাত আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে অবশ হয়ে যাচ্ছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না রহিমা। সে নিকটবর্তী ফার্মেসীতে গেল এই সমস্যার জন্য। ফার্মেসী থেকে তাকে ব্যথা কমার ঔষধ দিল। সেটা খাওয়ার পর ব্যথা কিছুটা কমলো। কিন্তু হাত আরও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে এবং সে হাত আর নাড়াতে পারছে না। ইতোমধ্যে ১ দিন পার হয়ে গেল।অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না দেখে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। জরুরীবিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক স্ট্রোক হয়েছে ভেবে তাকে নিউরোমেডিসিন বিভাগে ভর্তি করে দিল। ব্রেইনের সিটিস্ক্যান পরীক্ষা করা হলো। কোন কিছু পাওয়া গেল না। এদিকে তার হাতের আঙ্গুল আস্তে আস্তে কালো হয়ে গেল। আরও একদিন পার হয়ে গেল। তার হার্টের ইসিজি পরীক্ষা করে দেখা গেলো হার্টের গতি অস্বাভাবিক। ইতিহাস নিয়ে জানা গেল ছোটবেলায় তার বাতজ্বর হয়েছিল। হার্টের ইকোকার্ডিওগ্রাম করে তার হার্টের সমস্যা পাওয়া গেল। তার হার্টের বাল্বে ছিদ্র আছে যাকে মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় বলা হয় মাইট্রাস স্টেনোসিস। অবশেষে রহিমাকে তার হাত হারাতে হলো।

আসলে কী হয়েছিলো রহিমার?
ভাসকুলার সার্জন হিসেবে প্রতিনিয়ত আমাদের এইরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। রহিমার এই সমস্যার নাম এক্যুইট লিম্ব ইস্কেমিয়া যার মানে হচ্ছে হঠাৎ করে তার বাম হাতের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর কারন হিসেবে থ্রম্বোএম্বোলিজমকে দায়ী করা হয়। থ্রম্বোএম্বোলিজম হচ্ছে শরীরে কোথাও রক্ত জমাট বেঁধে সে জমাট রক্ত (Thrombus) অন্য কোন রক্ত নালীকে বন্ধ করে দেয়। আর রহিমার এই থ্রম্বোএম্বোলিজমের কারন হচ্ছে তার হৃদরোগের সমস্যা যার জন্য তার হৃদপিণ্ডের গতি অস্বাভাবিক ছিলো এবং হার্টে তার রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিলো।

কেন হতে পারে এমন সমস্যা?
কারো হাত বা পায়ের হঠাৎ রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে একে এক্যুইট লিম্ব ইস্কেমিয়া বলা হয়। এর কারনগুলোর মধ্যে বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ, হৃদপিন্ডের অস্বাভাবিক গতি (Atrial fibrillation). মহাধমনীতে চর্বি জমা বা মহাধমনী অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যাওয়া, যেকোন রকম দূর্ঘটনার পর রক্ত জমাট বাঁধা সহ আরও বেশ কিছু কারন উল্লেখযোগ্য। রোগের উপসর্গ , লক্ষন এবং রোগের ইতিহাস থেকেই প্রাথমিক ধারোনা পাওয়া যায়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে রোগীরা হাত বা পায়ে হঠাৎ তীব্র ব্যথার কথা বলে। আক্রান্ত হাত বা পা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যায় , যাকে বলে perishing cold (সাপের গায়ে হাত দিলে যেরকম ঠান্ডা অনুভূত হয় সেইরকম ঠান্ডা)। হাত, পা আস্তে আস্তে অবশ হয়ে আসে, ফ্যাকাসে হয়ে যায়। হাত বা পায়ের আঙ্গুল কালো হতে শুরু করে। রোগীর আক্রান্ত হাত বা পায়ের পালস পরীক্ষা করলে পালস পাওয়া যায় না। অনেকসময় পালস অনিয়মিত পাওয়া যায়। রোগী একসময় বলে আর ব্যথা নাই আসলে ততক্ষনে রোগীর আক্রান্ত অংশ আর জীবিত নাই।

কী করতে হবে?
মনে রাখতে হবে এইসব রোগীর চিকিৎসায় সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোগের লক্ষন শুরু থেকে প্রথম ৬-৮ ঘন্টাকে বলা হয় গোল্ডেন আওয়ার। কাজেই কারো এই লক্ষনগুলো দেখা দিলে অতি জরুরীভাবে কোন ভাসকুলার বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করতে হবে অথবা রোগীকে এইরকম হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে যেখানে ভাসকুলার সার্জারীর সুযোগ সুবিধা রয়েছে। সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় চিকিৎসা নিতে পারলেই রোগীর হাত বা পা বাঁচানো সম্ভব। অনেকসময় রোগীর জীবনও রক্ষা পায় সময়মতো চিকিৎসা নিতে পারলে।

কী পরীক্ষা করতে হবে?
ডুপ্লেক্স (যা আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনের মাধ্যমে করা হয়) নামক একটি পরীক্ষা করেই রোগ নির্নয় করা যায়। অনেকসময় হাত বা পায়ের এনজিওগ্রাম পরীক্ষা করা হয়। এনজিওগ্রাম পরীক্ষার মাধ্যমে রোগের বিস্তৃতি এবং কী ধরনের চিকিৎসা লাগবে তা ঠিক করা হয়।। এছাড়া ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম এবং যাদের হাতের সমস্যা তাদের ঘাড়ের এক্সরে করতে হয়।

কী চিকিৎসা করা হয়?
এইসব রোগী চিকিৎসা যেকোন ভাসকুলার সার্জনের জন্যই চ্যালেঞ্জিং। রোগী আসার সাথে সাথে যতদ্রুত সম্ভব রক্ত পাতলা করার ঔষধ শুরু করতে হয়। অনেকসময় রোগের অবস্থার উপর ভিত্তি করে সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। বিশেষধরনের বেলুনের মাধ্যমে (Fogarty Embolectomy) জমাট বাঁধা রক্ত পরিষ্কার করা হয়। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাইপাস অপারেশন করা হয়।
বর্তমানে উন্নত বিশ্বের মতো কাটাছেড়া না করে এন্ডোভাসকুলার পদ্ধতির মাধ্যমেও এই রোগের চিকিৎসা করা যায়। এই ক্ষেত্রে মেকানিকেল থ্রম্বেকটমি , ক্যাথেটার ডিরেক্টেড থ্রোম্বোলাইসিস, এঞ্জিওজেট নামক মেশিনের মাধ্যমে রক্ত পরিষ্কার করা যায়। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে রক্তনালীতে স্টেন্ট বা রিং বসিয়েও চিকিৎসা করা সম্ভব।

এই রোগের সময়মত চিকিৎসা করাতে না পারলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর ভয়াবহ পরিনতি হতে পারে যেমন আক্রান্ত হাত বা পা কেটে ফেলতে হয়। অনেকসময় রোগীর কিডনী বিকল হয়ে পড়ে। এছাড়াও অন্যান্য মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয় এমনকি রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে। কাজেই সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় সঠিক চিকিৎসা এই সমস্যার একমাত্র সমাধান।
আসুন সবাই সচেতন হই এবং সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় চিকিৎসা নিই।


ডাঃ জুবায়ের আহমেদ
ফেলো (ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল), সিঙ্গাপুর
সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী কনসালটেন্ট
ভাসকুলার সার্জারী বিভাগ
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্স ইনস্টিটিউট।
যোগাযোগের ফোন নংঃ ০১৭৮৯ ৫৭০ ২৪০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here