মন্ত্রণালয়ে কি আলোচনা করেছিলেন নার্স প্রতিনিধিগণ ?

কায়সার হামিদ লিমন, ঢাকা, ১৮ মার্চ ২০২১, ০৯ঃ০০
সাম্প্রতিক স্বাস্থ্যখাতের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু কারিগরি শিক্ষা বোর্ড হতে পাশকৃত পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের নার্সিং এর সমমান করার প্রক্রিয়া। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে নার্সিং বিশেষজ্ঞ ও নেতৃবৃন্দের মতামত উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত অনেকদূর গড়িয়েছে।

নার্সেস সংগ্রাম পরিষদ , বাংলাদেশ ডিপ্লোমা স্টুডেন্ট নার্সেস এসোসিয়েশন, বেকার নার্সেস এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ বেসিক গ্রেজুয়েট নার্সেস স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ প্রাইভেট নার্সিং কলেজ স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন সহ বিভিন্ন নার্সিং সংগঠন দীর্ঘদিন যাবৎ তিন দফা দাবীতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোন কর্ণপাত না করেই তাদের একক সিদ্ধান্ত নিয়েই চলেছিলেন বলে নার্স নেতৃবৃন্দের অভিযোগ।

সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ জানান, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড হতে পাশকৃত পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের বিষয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ উপেক্ষা করেই অদৃশ্য কারণে কিছু কর্মকর্তা অতি উৎসাহি হয়ে বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের ঘাড়ে বন্ধুক রেখে শিকার করে যেতে চাচ্ছেন। তারা বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের অধিভূক্ত বা নিবন্ধিত নয় মনগড়া একটি কোর্সকে নার্সিং কোর্সে পরিনত করতে চাচ্ছেন।

এতে বাঁধ সাধেন সাধারন নার্সিং কর্মকর্তা ও ছাত্রছাত্রীবৃন্দ। আদালত অবমাননার সুস্পষ্ট অভিযোগ দিয়ে আইনী নোটিশ প্রেরণ করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা সচিব, স্বাস্থ্য শিক্ষা সচিব অতিরিক্ত সচিব, উপসচিব (শিক্ষা), নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের রেজিস্টার এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর এর মহাপরিচালক বরাবর। এতেই টনক নড়ে, নার্স নেতৃবৃন্দকে ডাকা হয় আলোচনার জন্য। প্রথমবারের মতো আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় দীর্ঘ সময় নিয়ে ।

আলোচনা সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে পেশাজীবি চিকিৎসক প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব ডা. ইকবাল আর্সলান।

অন্যান্যদের মধ্যে স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য শিক্ষা সচিবের সাথে উপস্থিত ছিলেন ০৬ জন অতিরিক্ত সচিব। ছিলেন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তার, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল এর রেজিস্টার সুরাইয়া বেগম, স্বাস্থ্য শিক্ষার উপসচিব জনাব ইশরাত জামান প্রমুখ।
নার্স প্রতিনিধিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখার সভাপতি কামাল হোসেন পাটোয়ারী এবং স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের মহাসচিব ইকবাল হোসেন সবুজ, স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের সদস্য সচিব আনিসুর রহমান, বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখা স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান নাসরিন সুলতানা, স্বানাপ ঢামেকহা শাখা সভাপতি নার্গিস খানম মুন্নিসহ কয়েকজন তরুণ নার্সিং কর্মকর্তা।
আলোচনা সভার বক্তব্য শুরু করেন স্বাস্থ্য শিক্ষা সচিব মহোদয়। তিনি করোনাকালীন সময় নার্সদের ভূমিকার ভূয়শী প্রশংসা করেন এবং তাদের অসীম সাহসিকতার কারণে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মতামত প্রকাশ করেন। কথার প্রেক্ষিতে তিনি নার্সদের সমসাময়িক বিভিন্ন উন্নয়ন এবং তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে তার আন্তরিকতা প্রকাশ করেন। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ দ্রুত চলমান আছে বলে তিনি তাদেরকে আশ্বস্ত করেন।
এরপরে মূল আলোচনায় গিয়ে তিনি আশ্বস্ত করে বলেন যে, সকল পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্ট সরাসরি নার্স হতে পারবে না। যারা শুধুমাত্র কম্প্রিহেনসিভ লাইসেন্সিং (নার্সি কাউন্সিল এর) পরীক্ষা পাস করবেন তারাই নার্স হওয়ার যোগ্য হবেন এবং সেই সংখ্যা খুব বেশি না। এ ব্যাপারে উপর মহলের নির্দেশ আছে আছে বলে তিনি জানান। তিনি এ ব্যাপারে নার্সিং নেতৃবৃন্দসহ নার্স সমাজের সহযোগিতা চান। উক্ত ঘটনায় আন্দোলনসহ নানাবিধ কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রী মহোদয়কে আর বিব্রত না করার অনুরোধ জানান। পরিশেষে এ ব্যাপারে সবার সার্বিক সহযোগীতা কামনা করেন এবং উদ্ভুত সমস্যার আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান করতে আগ্রহী বলে জানান।

নার্সিং নেতৃবৃন্দদের পক্ষে প্রথম বক্তব্য উপস্থাপন করেন স্বানাপের মহাসচিব ইকবাল হোসেন সবুজ। তিনি স্বাস্থ্য শিক্ষা সচিব মহোদয়ের বক্তব্যের কিছু অংশের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। কারিগরি পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের নার্স বাদ দিয়ে অন্য যে কোন পদ, এমনকি প্রথম শ্রেণীর পদে পদায়ন করলেও এই ব্যাপারে তার কোনো আপত্তি নেই বলে সরাসরি জানান। স্বানাপ মহাসচিবের ব্যক্তবের মূল সারাংশ ছিল এটাই যে, কারিগরি পেশেন্টে কেয়ার টেকনোলজিস্টদের নার্স পদবী বাদ দিয়ে অন্য যে কোন পদ/পদবী বা যে কোন গ্রেড প্রদান করলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবেনা। কিন্তু কোনোভাবেই পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের নার্স পদ-পদবি দেয়া যাবে না। তারপরেও আমাদের মতামত উপেক্ষা করে যদি এ ধরনের স্বিদ্বান্ত নেয়া হয়, তা হবে জনস্বাস্থ্যের জন্য বিশাল হুমকি। স্বানাপ মহাসচিব অতিসত্বর ডিপ্লোমা (নার্সিং ও মিডওয়াইফারী) এবং বিএসসি শিক্ষার্থীদের, যাদের কম্প্রিহেন্সিব পরীক্ষা বন্ধ হয়ে আছে তাদের পরীক্ষা দ্রুত নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুরোধ জানান।

এরপর বক্তব্য রাখেন স্বানাপ সদস্য সচিব আনিসুর রহমান। তিনি বক্তব্যের শুরুতে বলেন কারিগরি পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টরা আমাদেরই ভাই বোন, আমাদের সমাজের অংশ। যেহেতু তারা পড়ালেখা করেছে, চাকরি পাওয়া তাদের অধিকার। তাদের একটা সুব্যবস্থা করতে হবে এবং সেটা সম্মানজনক ভাবেই। কিন্তু তাদেরকে সম্মানিত করতে গিয়ে নার্সদের সম্মান এবং অবস্থ্যানকে অবমূল্যায়ন করা যাবে না। নার্সিং বিশ্বস্বীকৃত একটি পেশা এবং এর অবশ্যই বৈশ্বিক মানের সাথে সামঞ্জস্যতাপূর্ণ মূল্যায়ন থাকতে হবে। এ প্রেক্ষিতে স্মরণ করিয়ে দেন যে, যাকে তাকে যে কোন একটা ডিগ্রীর মাধ্যমে নার্স বানানো যাবে না এবং এ প্রক্রিয়া যদি চলমান থাকে তাহলে নার্স’রা কঠোর হস্তে প্রতিহত করবে।

এরপরে বক্তব্য রাখেন কামাল হোসেন পাটোয়ারী। তিনি ২০০৩ সালে বিএনপি-জামাতের আমলের স্টাফ নার্স পদে নিয়োগের ব্যাপারে কথা বলেন এবং উল্লেখ করেন দেশে স্টাফ নার্স পদ বর্তমানে সিনিয়র স্টাফ নার্স পদের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় সেই পদগুলো বিলুপ্ত করা হয়েছে। সেই সময়ের একটি ছোট সিদ্ধান্ত নার্সিং সমাজে কিন্তু বিশাল বড় বিরূপ প্রভাব রেখে গেছে। তিনি আরো বলেন যে নার্সিং কাউন্সিল মোট ১৪ টি কোর্সের রেজিষ্ট্রেশন দিয়ে থাকে যেমন ডিপ্লোমা ইন নার্সিং, বিএসসি নার্সিং, এমএসসি নার্সিং, সাইকিয়াট্রি নার্সিং ইত্যাদি। প্রয়োজনে ১৫ নাম্বার কোর্স এর লাইসেন্সিং পরীক্ষাটা “পেশেন্টের কেয়ার টেকনোলজিস্ট” হিসেবে নেয়া যেতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিষ্টদের নার্স বানানো যাবেনা।

এরপরে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের নার্স বানানোর পক্ষে কথা বলেন এবং বলেন এই সংখ্যাটা খুবই অপ্রতুল এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় কোন হুমকি হবে না। প্রধানমন্ত্রীর নানান ধরনের ভিশন, মিশন এবং ড্রিমের কথা বলেন এবং সর্বশেষ তার মতামত এদেরকে নার্সিং নিবন্ধন দেয়ার পক্ষে ব্যক্ত করেন।

এর পরে বক্তব্য রাখেন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তার। তিনিও বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি অনেক বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেন এবং নার্সিং এর চলমান উন্নয়ন ও নার্সদের মান নষ্ট হয় এমন প্রদক্ষেপ গ্রহণে তার দ্বিমত প্রকাশ করেন এবং বিশেষভাবে বিবেচনা করতে বলেন এবং আলোচনার মাধ্যমে একটা সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছার অনুরোধ করেন। নার্সিং এর উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সংখ্যা নয়, গুনগতমানের দিক বিবেচনা করতে হবে বলে মতামত প্রকাশ করেন।

স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদ (স্বানাপ) এর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখার সভাপতি নার্গিস খানম মুন্নি তার জোরালো বক্ত্যবে পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের নার্স বানানোর বিরুদ্ধে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বাস্থ্যখাতের ব্যাপক অর্জন এবং বিশ্বব্যাপী সুনাম, নার্সিং এ কারিগরি পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের অনুপ্রবেশে ব্যাহত হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের নার্সগন জাতির জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়নে দিন রাত কাজ করে যাচ্ছে, তাই উদ্ভুত এই সমস্যার সমাধানে নার্স দরদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় সুদৃষ্টি কামনা করেন।

এরপরে কথা বলেন বিবিজিএনএস এর সাবেক সভাপতি রাজিব কুমার বিশ্বাস। তিনি তার বক্তব্যে আইনী বিষয় এবং বিগত মামলার রায় সম্পর্কে বলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, এমএ/গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীদের নার্সিং এ নিয়ে আসার স্বপ্নের ব্যাপারে উল্লেখ করেন। রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভের একটি আদালত অবমাননা করা যাবে না। যেহেতু কারিগরি বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন সেহেতু বিচারের জন্য অপেক্ষা করার জন্য তিনি অনুরোধ করেন। সেই সাথে যাদের পরীক্ষা বন্ধ হয়ে আছে বিনা কারণে, তাদের পরীক্ষা দ্রুত নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুরোধ জানান।

মন্ত্রণালয়ের অন্য এক কর্মকর্তা (অতিরক্ত সচিব) অনুরোধ করেন মামলা-হামলায় না গিয়ে আলোচনার টেবিলে এই সমস্যাটি সমাধান করার জন্য। ঐ অতিরিক্ত সচিব উকিল নোটিশের ব্যাপারে কথা বলেন। তিনি আরো বলেন মামলা-হামলায় কিছু হবেনা অনেক উকিল নোটিশ আসছে এবং অনেক মামলা প্রক্রিয়াধীন। তিনি বিশেষভাবে অনুরোধ করেন এ ব্যাপারে মামলার পথে না গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার জন্য। উল্লেখ্য যে, প্রায় ০৮টি অমিমাংসিত মামলার কারনে প্রচুর বেগ পেতে হচ্ছে, স্বাভাবিক কর্মকান্ড ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সর্বশেষ কারিগরি ব্যপারে হাই কমান্ডের নির্দেশের ব্যাপারে স্মরণ করিয়ে দিলেন ডা. ইকবাল আর্সলান। তিনি বলেন এ ব্যাপারে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা যাবে না এবং অবশ্যই আলোচনার মাধ্যমে এটা শেষ করতে হবে। তিনি নার্স নেতাদের বিস্তারিত কাগজপত্র সংগ্রহ করে আরও বিশদভাবে উপস্থাপন করার জন্য বলেন। আগামী রবিবারের মধ্যে নেতৃবৃন্দের মতামত এবং পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা লিখিত আকারে পেশ করার অনুরোধ করেন।

পরিশেষে সভাপতি সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here