নীল পাড়ের সাদা শাড়ির যে আলো ছড়িয়েছিল উপমহাদেশব্যাপী

আজ ২৬ আগস্ট। ১৯১০ সালের এই দিনে পৃথিবীর আলো দেখেন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ এ মানবী । বাবা নিকোল বোজেক্সাকে হারিয়েছিলেন মাত্র আট বছর বয়সে। বাবার মৃত্যু যেন দুঃখ-কষ্ট আর বিভিন্ন প্রতিকূলতা নিয়ে আসে পুরো পরিবারের ওপর। ড্রানাফিলের চার্চের প্রতি ছিলেন প্রবল অনুগত। এ আনুগত্য পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান এগনেস গোক্সি বোজেক্সার (পরবর্তীতে মাদার তেরেসা) ওপর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাব ফেলে।

কুষ্ঠ রোগ নিশ্চয় জানেন! কুষ্ঠ রোগী তো রোগী নয়! তখনকার সমাজে কুষ্ঠরোগীদেরকে মনে করা হতো অনাকাঙ্খিত, রোগ ধরা পড়ামাত্রই পরিবার তাদের ত্যাগ করে দিত। ভাগ্য, জীবন ও সমাজ কেউই যাদের গ্রহণ করেনি কোনোকালেই সে সকল অনাশ্রিত, অসমর্থ, অসুস্থ, অবহেলিত, স্নেহবঞ্চিত মানুষদের কাছে সহানুভূতি, স্নেহ, সেবার অবিচল প্রতিশ্রুতির এক মূর্তরূপ নিয়ে যিনি আসছিলেন তিনি আর কেও নয় তিনিই মাদার তেরেসা।

ভারতে আসেন নীল পাড়ের সাদা শাড়িতে; এসেছিলেন বিপন্ন, অসুস্থ, অসুখী আর হতদরিদ্র মানুষের কাছে আশার আলো হয়ে। এই পৃথিবীর কাছে এমনকি সমাজ ও পরিবার থেকে বিতাড়িত, চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত কুষ্ঠরোগীদের তিনি শুধু আশ্রয়ই দেননি, প্রাণের মায়াকে তুচ্ছ করে নিজ হাতে তাদের সেবা করেছেন দিনের পর দিন।

মাত্র আঠারো বছর বয়সে ঘর ছেড়ে পৃথিবীর পথে পা বাড়ান এগনেস, নিজেকে উৎসর্গ করেন রুগ্ন-ক্লিষ্ট মানবতার সেবার জন্য। তার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় একটি মিশনারী পরিচালিত স্কুলে, পরে শিক্ষাগ্রহণ করেন রাষ্ট্রচালিত একটি মাধ্যমিক স্কুলে।

মানবসেবাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে ঘর ও সংসার জীবনের আনন্দ ত্যাগ করে এসে তিনি যোগ দেন আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে মিশনারী মেয়েদের দল ‘সিস্টার্স অব লোরেটো’তে এবং সেখানেই তিনি সাধু সেইন্ট তেরেসার নামানুসারে ‘সিস্টার ম্যারি তেরেসা’ নাম গ্রহণ করেন।

তিনি ভারতে পাড়ি জমান এবং দার্জিলিংয়ে ধর্মপ্রচারের কাজ শুরু করেন। পূর্ব কলকাতায় বহু বছর তিনি মিশনারির মেয়েদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পদে নিযুক্ত ছিলেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি খুব ভালো বাংলা ও হিন্দী শিখে নেন।

৩৬ বছর বয়সে তিনি নিজের হৃদয়ে ভারতের গরীব অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার তাড়না অনুভব করেন। তিনি নিজের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন জায়গা থেকে মৌলিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নেন, আর তারপর বেরিয়ে পড়েন ভারতের রাস্তায় দরিদ্রের মধ্যে, যারা হতদরিদ্র, অভাগাদের মধ্যেও যারা সবচেয়ে অসহায়, সেই আশাহীন, সহায়-সম্বলহীন মানুষদের জন্য।

খুবই সামান্য সম্বল নিয়ে ১৯৪৮ সালের ভারতে এটা কোনো সহজ কাজ ছিল না। সে বছরের ১৭ই আগস্ট তিনি নীল পাড়ের সাদা শাড়ি তুলে নেন সারা জীবনের জন্য। ধীরে ধীরে তাঁর এই শাড়িই হয়ে ওঠে বস্তি থেকে রাস্তা পর্যন্ত কলকাতার সকল অবহেলিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, স্নেহহীন মানুষদের জন্য আশা ও মমতার প্রতীক।

নিজের প্রার্থনার খাতায় তিনি লিখে যান- “হে ঈশ্বর, আমাকে শক্তি দিন এই মানুষগুলোর জীবনের আলো হয়ে ওঠার, যেন আমি তাদেরকে অন্তত আপনার দিকে ফেরাতে পারি।” যেন তাঁর ধর্মীয় সকল জ্ঞান আর নিজের সমস্ত চেতনা তাঁকে এক মুমূর্ষু ও দুস্থ মানবতার সেবার জন্য ডাকছিলো।

১৯৫০ সালের ৫ই অক্টোবর কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে স্বীকৃতি পেয়ে এটি ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ নামে পথ চলা শুরু করে। ১৯৬৫ সালে পোপ ষষ্ঠ পলের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়ে এটি একটি আন্তর্জাতিক সেবামূলক ধর্মীয় পরিবার হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল আর সমগ্র পৃথিবী থেকে মাদার তেরেসার এই প্রতিষ্ঠানটি অর্থ সাহায্য পেতে থাকে আর তার সাথে বাড়তে থাকে তাদের কর্মের পরিধি।

১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে মাদার তেরেসা গড়ে তোলেন কুষ্ঠরোগীদের জন্য একটি আশ্রম, একটি অনাথ আশ্রম, একটি নার্সিং হোম, একটি মা ও শিশু ক্লিনিক এবং অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে গঠিত একটি ভ্রাম্যমান ক্লিনিক।

অবহেলিতদের জন্য জীবনের প্রতিটি বছর এক এক করে উৎসর্গ করতে থাকেন মহৎপ্রাণ এই মানুষটি। এরই মধ্যে ১৯৬৩ সালে মানবসেবায় জীবন উৎসর্গ করা ছেলেদের নিয়ে ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি ব্রাদারস’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

আজ জন্মদিন সেই মহামানবীর। জন্মদিনে অনেক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here