কোভিড -১৯ এ মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারন – কোগলোপ্যাথি (Coagulopathy)

সারাবিশ্বে এখন এক আতঙ্কের নাম কোভিড -১৯। আমরা সবাই করোনা মহামারির এক কঠিন সময় পার করছি। বিশ্বের প্রায় ২১৫টি দেশ সংক্রমিত। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪ কোটির উপরে এবং মৃত্যুর সংখ্যা ইতোমধ্যে ১১ লক্ষ ছাড়িয়েছে। এই সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনের অগ্রগতি। আশাকরা যাচ্ছে খুব শীগ্রই এই ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। গবেষণায় কোভিড – ১৯ সংক্রমিত রোগীর মৃত্যুর অন্যতম কারন হিসেবে কোগলোপ্যাথিকে দায়ী করা হচ্ছে।

কোগলোপ্যাথি বলতে সাধারণত আমাদের শরীরের হিমোস্টেসিসের কোনরকম ব্যাঘাত ঘটাকেই বুঝায়। যার ফলে শরীরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরন অথবা রক্তজমাট বাঁধতে পারে। কোভিড – ১৯ সংক্রমিত যেসব রোগীর তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমন ঘটে তাদের কোগলোপ্যাথির ঝুঁকি অনেক বেশী। বয়স্ক এবং আগে থেকেই যারা বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভুগছেন, তারাও ঝুঁকিপূর্ণ।

করোনা আক্রান্ত যেসব রোগীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তির প্রয়োজন হয় তাদের কোগলোপ্যাথির ঝুঁকি অনেক বেশী। এছাড়াও কোভিড সংক্রমিত হাসপাতালে ভর্তি যেসব রোগীর ভেনাস থ্রম্বোএম্বোলিজম বা শিরায় ব্লক, পালমোনারী এম্বোলিজম বা ফুসফুসের রক্তনালীতে ব্লক, হার্টের ব্লক এবং ব্রেইন স্ট্রোক দেখা যায় তাদের কোগলোপ্যাথির ঝুঁকি অনেক বেশি।

যেসব রোগীর ভেনাস থ্রম্বোসিস বা শিরায় ব্লকের অত্যাধিক ঝুঁকি রয়েছে যেমন অজ্ঞান রোগী, যেসব রোগী নড়াচড়া করতে পারেনা, তীব্র প্রদাহজনিত অবস্থা (একুইট ইনফ্লামেটরি স্টেট) এবং যাদের রক্তের অক্সিজেনের পরিমান অনেক কম (হাইপোক্সিয়া) তাদেরও কোগলোপ্যাথির ঝুঁকি অনেক বেশী। কিছু করোনা রোগী যাদের ডেসিমিনেটে ইনট্রাভাসকুলার কোগলেশন (DIC) দেখা দেয় তাদের কোগলোপ্যাথির ঝুঁকি অত্যাধিক বেশী। ডিআইসি হচ্ছে এমন একটা অবস্থা যাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্তনালী বন্ধের কারনে সারাশরীরে রক্ত জমাট বেধে যায়। প্রসাব পায়খানার সাথে বা চামড়ার নীচে রক্ত দেখা যায়।

গবেষনায় দেখা যায় ডিআইসি (DIC) দেখা দিয়েছে এমন রোগীর মৃত্যুর হার অনেক বেশী প্রায় ৭১ শতাংশ। যেখানে বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র ০.৬ শতাংশ। বাকিরা অন্যান্য জটিলতায় ভোগে।
করোনায় আক্রান্ত রোগীর অবস্থার অবনতির অনেক কারনই এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। এটা নিয়ে গবেষনা চলছে। তবে রোগীর অবস্থার অবনতির অন্যতম প্রধান একটি কারন মনে করা হয় শরীরে অতিরিক্ত প্রো- ইনফ্লামেটরি সাইটোকাইন তৈরী হওয়া (এটি সাইটোকাইন স্ট্রম নামে পরিচিত) যার ফলে কোগলেশন ক্যাসকেড সচল হয়; ফলে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় থ্রম্বোটিক ইভেন্ট (রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা) ঘটে। যার ফলে শরীরে অনেক অঙ্গ বিকল হয়ে পড়ে যাকে মাল্টি অরগান ফেইলর বলা হয়। ফলশ্রুতিতে রোগীর মৃত্যু ঘটে।

আমরা কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কোগলোপ্যাথি নিশ্চিত করতে পারি। যার মধ্যে রক্তের ডি-ডাইমার (D-dimer) এবং প্রো- থ্রোম্বিন এর মাত্রা উল্লেখযোগ্য। ডি-ডাইমার প্রায় ৩-৪ গুন বেড়ে যেতে পারে এবং প্রোথ্রম্বিন টাইম (PT) ও দীর্ঘায়িত হয়। রক্তের অনুচক্রিকা (Platelet) ১ লক্ষের নীচে নেমে আসে। সিআরপি (CRP) ও অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া শিরায় ব্লক ডুপ্লেক্স পরীক্ষা ( যা আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনে করা হয়) করে নিশ্চিত হওয়া যায়। ফুসফুসের রক্তনালীর ব্লক আছে কিনা তা পালমোনারি সিটি এনজিওগ্রাম নামক পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়।

করোনা রোগের চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। বিজ্ঞানীরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ভ্যাকসিন আবিস্কারের জন্য। তবে করোনা চিকিৎসায় অক্সিজেন থেরাপী এবং রক্ত পাতলাকরার ঔষধ এখন পর্যন্ত পরীক্ষীত ভাবে প্রমানিত। অন্যান্য চিকিৎসা উপসর্গের ভিত্তিতে দেওয়া হচ্ছে। যাদের অনেক বেশী অক্সিজেন প্রয়োজন হয় তাদের কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের (Artificial life support) প্রয়োজন পড়ে। যদিও এখন কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র এড়িয়ে চলতে বলা হয়। সেক্ষেত্রে হাই নেজাল ফ্লোমিটার ও নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন (NIV) বেশ গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রাখতে পারে বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।

আমাদের কিছু প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব রোগীর ভেনাস থ্রম্বোসিস বা শিরায় ব্লকের সম্ভাবনা বেশী তাদেরকে প্রথমেই ঘন ঘন পজিশন (পাশ) পরিবর্তন করতে হবে। একধরনের বিশেষ মোজা (graduated compression stockings) ব্যাবহার করা যায়। এছাড়া ইন্টারমিটেন্ট নিউমেটিক কম্প্রেশন ডিভাইস ও বেশ উপকারে আসে।

গুরুতর কোভিড – ১৯ রোগীর ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্য মূল্যায়নের পাশাপাশি কোগলেশন মার্কারগুলো মূল্যায়ন করলে কোন কোন রোগীর নিবিড় পর্যাবেক্ষন দরকার তা আগে থেকেই নির্নয় করা যাবে যা এইসব রোগীর চিকিৎসায় সহায়তা করবে।


ডাঃ জুবায়ের আহমেদ
ফেলো (ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল), সিঙ্গাপুর
সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী কনসালটেন্ট
ভাসকুলার সার্জারী বিভাগ
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্স ইনস্টিটিউট।
যোগাযোগের ফোন নংঃ ০১৭৮৯৫৭০২৪০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here